মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলিয়াছেন: নিট বা জেইই-র জন্য যে সকল ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষার জন্য রাজ্যের ভিতরে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে যাইতে হইবে কিংবা রাজ্যের বাহির হইতে আসিতে হইবে, এই করোনা-আবহে তাহাদের কথা কি ভাবিল না কেন্দ্রীয় সরকার? এত বড় পরীক্ষার দিন তাহারা ধার্য করিল, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে এখনও প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত কিছু দিন লকডাউন চলিতেছে, এবং অন্যান্য দিনেও সাধারণ যানবাহন, সাধারণ দিনযাপন স্থগিত রহিয়াছে? প্রশ্নটির কোনও সঙ্গত উত্তর নাই। এই প্রশ্নের উত্তরও নাই যে— যে সব পরীক্ষার্থী হয়তো বাড়ির কাছাকাছি পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে যাইবার সুযোগ পাইবেন, তাহাদের নিরাপত্তাই বা নিশ্চিত করা যাইবে কী প্রকারে? কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা সর্বোচ্চ আদালতের অবিচলিত নির্দেশ, পরীক্ষার দিন পিছাইবে না। যুক্তি: নতুবা ছেলেমেয়েদের মূল্যবান সময় নষ্ট হইবে। কিছু বড় মাপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে মত দিয়াছে। স্পষ্টতই, সময় কিংবা কেরিয়ারের অপেক্ষা প্রাণ কিংবা স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার দাম তাঁহাদের নিকট কম। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সমস্ত স্বাভাবিকতা নষ্ট হইলেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার রুটিনের দাম তাঁহাদের বিবেচনায় বেশি। অতীত দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও তাঁহারা মানিতে নারাজ, পরীক্ষা পিছাইলে যদি অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারে কিছু পরিবর্তন করিতে হয়, তাহা করা অসম্ভব নহে। মানিতে নারাজ যে, এত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ যে পরীক্ষা, মাস্ক ও গ্লাভস পরিহিত পরীক্ষার্থীরা স্বচ্ছন্দ ভাবে সেই পরীক্ষা দিতে অপারগ হইতে পারে। ভারতের মতো অতি-উষ্ণ, অতি-আর্দ্র পরিবেশে, অসম অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে এই ভাবে পরীক্ষা দেওয়া সহজ কথা নহে।
বাস্তবিক, ডাক্তারি ও জয়েন্ট-এর প্রবেশিকা পরীক্ষা আকারে প্রকারে গুরুত্বে এতই বড়, এত সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর জীবন ইহার উপর নির্ভরশীল বলিয়াই এ বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া দরকার ছিল। পরীক্ষার্থীদের এক বিরাট অংশ অতিমারির প্রকোপে নিজেদের গ্রাম-মফস্সলের গৃহাভ্যন্তরে অন্তরিন, কী ভাবে তাহারা সকলে নির্ধারিত পরীক্ষাকক্ষে পৌঁছাইবে, তাহাই একটি ধাঁধা। ঠিক যেমন ধাঁধা ছিল— দেশব্যাপী লকডাউন ঘোষণার সময়ে দেশের কোণে কোণে সর্বত্র ছড়াইয়া থাকা পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা সরকারি নীতিপ্রণেতাদের মাথা হইতে বাহির হইয়া যাওয়া। এই অতিমারি কালেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার একাধিক বার প্রমাণ করিয়াছে, নাগরিক সমাজের যে অংশ তুলনায় কম সচ্ছল, স্বল্পসম্বল, তাহাদের কথা ভুলিবার প্রবণতা বিভিন্ন সরকারি নীতির মধ্যে প্রবিষ্ট। আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো জেইই-নিট পরীক্ষার দিন নির্ধারণের বিষয়টিতেও সেই প্রবণতা উজ্জ্বল হইয়া রহিল।
বিরোধী নেতারা বিষয়টি লইয়া একজোটে সরব হইয়াছেন, এক দিক হইতে আশার কথা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কাল ধরিয়াই পরীক্ষার তারিখ পিছাইতে অনুরোধ করিতেছিলেন, এ বার তাঁহার সহিত যোগ দিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী ও পঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খন্ড ইত্যাদির অবিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টে যাইতেছে তাঁহাদেরই উদ্যোগে। কিন্তু অন্য দিক দিয়া, শেষ পর্যন্ত যদি দেশের বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের প্রাণের সুরক্ষার বিষয়টি বিজেপি-অবিজেপি, সরকার-বিরোধী ইত্যাদি রাজনৈতিক কোন্দলের পূতিগন্ধে ডুবিয়া যায়, তাহা হইবে বিরাট দুর্ভাগ্য। এই দেশ এখন অতি-রাজনীতির সংক্রামক ব্যাধিতে ভয়াবহ ভাবে আক্রান্ত। প্রতিটি বিষয়ে দলমত-অন্ধতা তাহাকে বিষায়িত করিতেছে। অন্তত এই একটি বিষয়ে, দেশের সুকুমার কৈশোরের নিরাপত্তার স্বার্থে এই বিষাক্ত ভাবনাচিন্তা হইতে বাহির হওয়া প্রয়োজন। দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy