Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয়২

গোল পাকাইবার চেষ্টা 

ভারতীয় সমাজে একটি প্রধান উৎসব লইয়া ভিন্ন ভিন্ন মত থাকে, মূল ধারার অন্তরালে অন্তঃসলিলা অনেক ফল্গু থাকে। শুধু ‘দশেরানগরী’ মাইসুরু নয়, সাঁওতাল, মুন্ডা, আসুরি জনসমাজের লোককথায় মহিষাসুর তাঁহাদের রাজা। দেবী ছলাকলায় তাঁহাকে বধ করিয়াছেন। এই প্রান্তিক বিশ্বাসগুলি এত দিন মূলধারার পাশাপাশি অক্লেশে রহিয়াছে, আসুরি জনজাতির অনেকে আজও তাঁহাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুরের সম্মানে পূজার সপ্তমী অষ্টমী বা নবমীর রাত্রিতে আলো জ্বালান না।

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ ০২:০৭
Share: Save:

দেবদেবী লইয়া গোল পাকানো হিন্দুত্ববাদীদের চিরকালের অভ্যাস। এই বৎসর দশেরার পূর্বে অধুনা মাইসুরুতেও তাহার ব্যত্যয় ঘটিল না। প্রতি বারের মতো সেখানকার টাউন হলে স্থানীয় দলিত সংগঠন ‘মহিষ দশেরা’ উৎসবের আয়োজন করিয়াছিল। কর্নাটক সরকার শেষ মুহূর্তে অনুমতি দেয় নাই। স্থানীয় বিজেপি সাংসদ দলিতদের উদ্দেশে ফুট কাটিয়াছেন, তাঁহাদের মহিষাসুরের বংশে জন্ম হইলে অন্ধকার ঘরে উৎসব পালন করুন, প্রকাশ্যে নহে। এই গণতন্ত্রের দেশে দলিতেরা পাল্টা বলিতে পারেন নাই, মহিষাসুরের বংশ লইয়া প্রশ্ন করিলে পুরা মাইসুরু শহরটিকে নিষ্প্রদীপ করিয়া রাখিতে হয়। কিংবদন্তি বলে, এই অঞ্চলের নৃপতি মহিষাসুরের নাম হইতেই ‘মহীশূর’ শব্দের উদ্ভব। সেখানকার চামুণ্ডী মন্দিরসংলগ্ন মহিষাসুরের বিশাল মূর্তি। সেই মূর্তি মহিষের ন্যায় শৃঙ্গী নহে, বিশাল গুম্ফশোভিত খড়্গধারী এক বীর পুরুষ। মন্দিরের অভ্যন্তরে চামুণ্ডী দেবীও নহেন সিংহবাহনা দশভুজা। বরং যোগাসনে বসা অষ্টভুজা। মহিষ দশেরার উদ্যোক্তারা মূর্তিতত্ত্বের এই সব যুক্তি স্থানীয় সাংসদ ও পুলিশকে জানাইতে পারেন নাই। জানাইলেও হয়তো লাভ হইত না।

ভারতীয় সমাজে একটি প্রধান উৎসব লইয়া ভিন্ন ভিন্ন মত থাকে, মূল ধারার অন্তরালে অন্তঃসলিলা অনেক ফল্গু থাকে। শুধু ‘দশেরানগরী’ মাইসুরু নয়, সাঁওতাল, মুন্ডা, আসুরি জনসমাজের লোককথায় মহিষাসুর তাঁহাদের রাজা। দেবী ছলাকলায় তাঁহাকে বধ করিয়াছেন। এই প্রান্তিক বিশ্বাসগুলি এত দিন মূলধারার পাশাপাশি অক্লেশে রহিয়াছে, আসুরি জনজাতির অনেকে আজও তাঁহাদের পূর্বপুরুষ মহিষাসুরের সম্মানে পূজার সপ্তমী অষ্টমী বা নবমীর রাত্রিতে আলো জ্বালান না। বেতারের মহিষাসুরমর্দিনী, দুর্গাপূজার আলোকমালা ও নগণ্য জনজাতির বয়ান ভারতীয় সমাজে আজও পাশাপাশি রহিয়া যায়। সেখানেই ধর্ম। কর্নাটকের বিজেপি নেতা ঋগ্বেদ পড়িলে জানিতে পারিতেন, সেখানে ইন্দ্র, বরুণ, রুদ্র, অগ্নি অনেক বৈদিক দেবতাকেই অসুর বলা হইয়াছে। অসুর পূজার্হ বলিয়াই বঙ্গনারী আজও বিসর্জনের পূর্বে, বরণকালে অসুরের মুখে মিষ্টান্ন গুঁজিয়া দেন। বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ অনুযায়ী নবপত্রিকা পূজার পরেই প্রতিমাস্থিত মহিষাসুর ও অন্য দেবদেবীদের পূজা বিধেয়। নবরাত্রি ও রাবণবধের দশেরাসংক্রান্ত কিংবদন্তিটিই দেবীপূজার এক এবং একমাত্র বয়ান নহে।

ভারতীয় সমাজে অসুর এবং দুর্গার এই বিভিন্ন বয়ান একটিই কারণে। বিভিন্ন চিন্তার এই বাধাবন্ধহীন গতায়াত হইতেই ধর্মের উৎপত্তি। মাইসুরুর দলিত সংগঠনটি তাহাদের শোভাযাত্রার জন্য মহিষাসুরের পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধ এবং সম্রাট অশোকের নামাঙ্কিত রথও প্রস্তুত করিয়াছিল। তাহাদের বিশ্বাস, মহিষাসুর বৌদ্ধ ছিলেন। অসুর এবং বুদ্ধের এই একীভবনেই হিন্দুত্ববাদের আপত্তি। কিন্তু হিন্দু দর্শন ইহাতে কোনও ভুল পাইবে না। বুদ্ধ ও তাঁর পন্থাবলম্বী শ্রমণেরা বেদ ও যজ্ঞবিরোধী। সমসাময়িক বৈদিক সমাজে তাঁহারা বেদনিন্দক অসুর রূপেই প্রতিভাত হইতেন। অধিক বলিবার নাই, হিন্দুতন্ত্রে কালী, তারা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা প্রমুখ দশ মহাবিদ্যার ধারণা বৌদ্ধ তন্ত্র হইতে গৃহীত। রাষ্ট্রীয় বন্দোবস্তে সামাজিক গতিবিধির দ্বার রুদ্ধ করিলে অসুর বা দুর্গা কিছুই থাকে না, হিন্দুত্ববাদীরা কথাটি বুঝিলে মঙ্গল।

অন্য বিষয়গুলি:

Mahisha Dasara Hindu Fundamentalism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy