Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
Coronavirus Lockdown

প্রকৃতির সামনে পুতুল নাচ?

২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী শুধু কলকাতা শহরেই ৭০,০০০ গৃহহীন লোক। এখন সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে ধরে নেওয়া যায়।

মনীষা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২০ ০১:০৭
Share: Save:

কোভিড-১৯ এবং আমপান কি বুঝিয়ে দিল, মানুষ কত অসহায়? সন্দেহ নেই, এই ঘূর্ণিঝড় আমাদের রাজ্যের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের গত দুই মাসের মরচে পড়া চাকাটাকে আরও খানিক উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিল। মহামারির ছবির সঙ্গে ঝড়ের পর মানুষের দুর্দশার ছবি আমাদের মানসিক ভাবে ধ্বস্ত করছে। লক্ষণীয়, ঝড়ের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত যে দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, হাওড়া এবং হুগলি জেলার বেশ কিছু অংশ— সেই জেলাগুলিই আবার কোভিড সংক্রমণের দিক দিয়েও অনেক উপরে। এই সব জেলার অনেক অংশই মারাত্মক সংক্রামক অঞ্চল (রেড জ়োন) বলে চিহ্নিত এবং তার ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক দিন স্তব্ধ। স্বভাবতই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে যে সব আশ্রয়হীন মানুষকে নিরাপাদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেখানে প্রস্তাবিত দূরত্ব মেপে তাদের থাকতে দেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ ধরেই নেওয়া যায়, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এ বার আরও প্রবল হল।

২০১১ সালের গণনা অনুযায়ী শুধু কলকাতা শহরেই ৭০,০০০ গৃহহীন লোক। এখন সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে ধরে নেওয়া যায়। যদি শহর ও শহরাঞ্চলের বস্তিবাসীর সংখ্যা এর সঙ্গে যোগ করি, যাদের সিংহভাগ হয় আংশিক পাকা বাড়ি নয়তো ঝুপড়িতে বাস করে, তা হলে দুই ২৪ পরগনা এবং কলকাতা জুড়ে প্রায় ২৯ লক্ষ লোক কোনও না কোনও ভাবে এই ঝঞ্ঝার ফলে বিপন্ন। হয় তাঁরা সম্পূর্ণ গৃহহীন, নয়তো বাড়ি থাকলেও স্বাভাবিক জীবনাযাপনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হারিয়ে অসহায়। এর মধ্যে অধিক সংক্রমণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা সেই অসহায়তা আরও কতটা বাড়িয়ে তুলছে, আমরা অনুমান করতেই পারি।

সব মিলিয়ে এখন যে প্রশ্নের উত্তর আমাদের দ্রুত খুঁজে বার করতে হবে, তা হল— মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার উদ্দেশ্যে এই রেড জ়োন এলাকাগুলোকে রাজ্য প্রশাসন যে ওয়ার্ড ও বুথভিত্তিক তিনটি বিভাগে ভাগ করার কথা বলেছিল, সেখান থেকে কি আবার আমাদের নতুন করে ফিরে ভাবতে হবে? আবার কি আমাদের লকডাউন-জাতীয় বন্দোবস্তের কথা ভাবতে হবে, নামটা ব্যবহার করি আর না করি? ঘরবন্দি দিন কাটাতে হবে? সে ক্ষেত্রে কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্য আরও বাড়বে, ইতিমধ্যেই মহামারি ও ঝড়ের ফলে দিশাহারা যে জনগোষ্ঠী, তারা আরও বড় বিপদের মধ্যে পড়বে। কিন্তু অন্য কোনও উপায় আছে কি, এ ছাড়া? ভয়ঙ্কর কঠিন পরীক্ষা আমাদের সামনে।

এ তো গেল শহর এবং শহরাঞ্চলের কথা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা, যেমন গোসাবা (ছবিটি গোসাবা ব্লকের পুইঞ্জালি গ্রামের), বাসন্তী, কুলতলিতে রাইমঙ্গল, মাতলা নদীর বাঁধ ভেঙেছে। এই সব গ্রামের প্রধান কৃষিভিত্তিক উপার্জনের মাধ্যমই হচ্ছে ধান চাষ— যে ধানের জমি এখন গভীর নোনা জলের নীচে।

পশ্চিমবঙ্গের ২০১২-১৩ সালের পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যের মোট কৃষিজ উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ দেয় এই তিন জেলা। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা রাজ্যের যথাক্রমে ৯ এবং ৮ শতাংশ কৃষিপণ্যের জোগান দেয়। শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রেও এই তিন জেলা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, এই রাজ্যের শিল্পের ১৮ শতাংশ এবং পরিষেবার ২৮ শতাংশ আসে এখান থেকেই। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, সাম্প্রতিক দুই বিপর্যয়ের সম্মিলিত প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণটা কী দাঁড়াতে পারে। অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম আরও স্থগিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা, এবং তা ঘটলে আমাদের এই রাজ্য— যেখানে ২০১২ সালের তথ্য অনুসারে ২০ শতাংশ লোক দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে— তা এক অতীব গভীর সঙ্কটে তলিয়ে যেতে পারে।

কী ভাবব আমরা এই রকম এক বাস্তবের মধ্যে বসে? প্রকৃতি ভয়াল, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা কি এও ভাবব না যে, মানবসভ্যতার ইতিহাস শিখিয়েছে, মানুষ কী ভাবে তার চিন্তাভাবনা কাজকর্ম দিয়ে প্রকৃতিকে জয় করে এগিয়ে যায়? সেই বিবর্তনের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই কি আমরা আশা করব না যে, রাজনীতিবিদরা তাঁদের নীতি প্রণয়নের সময় এই সব অর্থনৈতিক তথ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেবেন, মানুষের স্বার্থকে সবচেয়ে জরুরি মনে করবেন, কোনও রাজনৈতিক বা দলতান্ত্রিক স্বার্থপরতাকে প্রশ্রয় দেবেন না? আমরা যেন প্রকৃতির সামনে ক্ষুদ্র অসহায় পুতুল না হই। উন্নততর মানুষ হিসেবে যেন আমরা আরও এক ধাপ এগোতে পারি। ২০১৮ সালের মানব উন্নয়ন সূচকের ভিত্তিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল সর্বোচ্চ এবং রাজ্যের মধ্যে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্থান ছিল যথাক্রমে ১,৩ এবং ৮। রাজ্যকে এবং তার এই জেলাগুলিকে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে আনার কাজ কঠিন হতে পারে, কিন্তু অসম্ভব যেন না হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Lockdown Cyclone Amphan Cyclone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy