Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

(গণ)সন্ত্রাসবাদ

গণতান্ত্রিক দেশে প্রকাশ্য গণসন্ত্রাস চলিতেছে, চলিবে। থামাইবার কেহ নাই, থামাইবার কারণও নাই। প্রধানমন্ত্রী এত দিনে গরু এবং সংখ্যালঘু, এই দুই বিষয়ক তাণ্ডব লইয়া হিরণ্ময় নীরবতার খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

পনেরো বৎসর বয়সি রোজা-ক্লিষ্ট বালকটি জানিতও না যে তাহার পরিচিতিটি এত সাংঘাতিক যে তাহাকে গণপিটুনিতে মরিতে হইবে। ভারতের নাগরিক হইয়াও সে মুসলিম: এই অপরাধে উন্মত্ত জনতার বলি হইতে হইবে। জানিবার কথাও নয়। সাত দশকের স্বাধীন ভারত অনেক অন্যায়, হিংসা, দাঙ্গা দেখিয়াছে ঠিকই, কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক দৈনন্দিন পরিস্থিতিতে, লোকাল ট্রেনের কামরায় বহু যাত্রীর নীরব উপস্থিতিতে, অসহায় মুসলিম বালকের দিকে এই ভাবে বহু লোক ধাবিয়া গিয়া ছুরিকাঘাতে তাহার প্রাণ লইবে, এমন ঘটনা এই দেশে এত দিন মোটেই সুলভ ছিল না। পরিবর্তনটি স্পষ্ট। ভারত এখন গণসন্ত্রাসের দেশ। শাসনতন্ত্রের পরিধির বাহিরে, আইন-শৃঙ্খলার বাহিরে এই সন্ত্রাসের সামনে গোটা অহিন্দু সমাজ পণবন্দির মতো দিনযাপন করিতেছে। জুনাইদ খানের পিতামাতা দিশাহারা শোকে ইদ কাটাইলেন। পুত্র হারাইবার সঙ্গে নিশ্চয় সেই শোকে মিশিয়া থাকিল নিজেদের বিপন্নতা বিষয়ে তাঁহাদের এত দিনের অজ্ঞানতার আত্মগ্লানি। অজ্ঞান না হইলে কি তাঁহারা বৎসরকার আনন্দের দিনে পুত্রদের এক ট্রেন হিন্দু যাত্রীর সঙ্গে বাজার করিয়া ফিরিতে দিতেন? তবে কিনা, অজ্ঞানতার দিন ফুরাইতেছে। মহম্মদ আখলাক হইতে জুনাইদ খান অবধি ঘটনা গড়াইবার পর পরিস্থিতি পাল্টাইতেছে। সংবাদে প্রকাশ, হরিয়ানা উত্তরপ্রদেশে মুসলিম মায়েরা আপাতত পুত্রসন্তানদের ফেজ টুপি পরিতে বারণ করিতেছেন, যাহাতে মুসলিম বলিয়া কেহ চিনিতে না পারে। ভারতীয় হইয়াও মুসলিম নামক পরিচিতির সংকট হইতে যাহাতে সন্তানরা অন্তত প্রাণে বাঁচিয়া ফিরিতে পারে।

গণতান্ত্রিক দেশে প্রকাশ্য গণসন্ত্রাস চলিতেছে, চলিবে। থামাইবার কেহ নাই, থামাইবার কারণও নাই। প্রধানমন্ত্রী এত দিনে গরু এবং সংখ্যালঘু, এই দুই বিষয়ক তাণ্ডব লইয়া হিরণ্ময় নীরবতার খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন। তাঁহার ভাবটি: তিনি অন্য নানা মহান কাজে ব্যস্ত (এই যেমন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়া অনাহূত ভাবে পাকিস্তানের মুণ্ড চর্বণ)। বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁহারই ইঙ্গিতে নীরবতা অভ্যাসে ব্যস্ত। তাঁহাদের ভাবটি: প্রতিবাদী উত্তেজনা আজ বাদে কাল উবিয়া যাইবে, আপাতত মুখে কুলুপ দিলে তাণ্ডবকারীরা পার পাইবে। ইত্যাকার সর্ব উপায়ে হিন্দুত্ব-সন্ত্রাসে নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন জোগাইতে কেন্দ্রীয় সরকার অত্যন্ত রূপে সফল। অবশ্যই সংসদে সংখ্যার বিপুলত্ব সংখ্যালঘু আক্রমণে সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। পাশাপাশি, বিরোধী রাজনীতিকরা নখদন্তহীন, তাঁহারা কিছু বলিবার আগেই প্রতিবাদবাক্য হাওয়ায় মিলাইয়া যায়। এবং নাগরিক সমাজের যেটুকু যাহা নৈতিক বিবেক, তাহা আপাতত বিপর্যস্ত, প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও সংবাদমাধ্যমের উত্তুঙ্গ সরকারপ্রীতির সামনে দিশাহীন। সংখ্যালঘুর ফিরতি আক্রমণের তো সম্ভাবনাই নাই। তাহা এই কারণেও যে, কোনও প্রতিবাদে যদি ইহার দশ শতাংশ হিংসাও দেখা যায়, তাহাতে হিন্দুত্ব-সন্ত্রাস আরও বলশালী হইয়া উঠিবে। বিপদ কমিবে না, অনেক গুণ বাড়িবে।

সুতরাং ভারতীয় রাজনীতি আত্মসচেতন ভাবে একটি নূতন পর্বে পা দিয়াছে। সংখ্যাগুরু সন্ত্রাসের পর্ব। যে কথা এত দিন পরিহাসচ্ছলে ফিরিতেছিল, তাহা এখন অক্ষরে অক্ষরে সত্য। একটি মানুষের প্রাণের মূল্য এখন মনুষ্যেতর প্রাণীর অপেক্ষা অনেক, অনেক কম। তাই গোহত্যার আশঙ্কায় গোটা ভারত শিহরিয়া উঠে, অন্য দিকে গোহত্যা হইবার গুজবেই একের পর এক মানুষের প্রাণ বলি যায়, প্রশাসন নড়িয়া বসে না। রাষ্ট্রপতি ভবনে সাত দশকে প্রথম বার ইদ-মিলন উৎসবটি জমিল না, কেননা তাহা আর ‘জাতীয়’ উৎসব নয়। আর নরেন্দ্র মোদীর তিন বৎসরে মুসলিম নিধন নামক উৎসবটি ভারতীয় সমাজের অতি প্রিয় হইয়া উঠিল, কেননা তাহা ‘জাতীয়তাবাদী’ বিনোদন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy