Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Proverb

‘প্রবাদভূম রাঢ়ভূম’: জনজীবনের ভাষা

প্রবাদ হল, পরম্পরাগত বাক্য, জনশ্রুতি, জনরব বা কিংবদন্তী। ঠিক কবে প্রবাদের সৃষ্টি তা যেমন বলা যায় না, তেমনি প্রবাদের কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। তবে প্রবাদ যে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রসূত ফসল তাতে সন্দেহ নেই। লিখছেন শিবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমরাঢ়ে প্রচলিত প্রবাদসমূহের সঙ্গে বৃহত্তর রাঢ়ের অপরাপর অংশে প্রচলিত প্রবাদ-মালার ভাব ও বিষয়গত ভিন্নতা লক্ষিত না হলেও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা দৃষ্টিগোচর হয়।

 মহিলাদের জীবনের অংশ গ্রাম্য প্রবাদবাক্য। ছবি: সুজিত মাহাতো

মহিলাদের জীবনের অংশ গ্রাম্য প্রবাদবাক্য। ছবি: সুজিত মাহাতো

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:২৭
Share: Save:

সহজ সরল গ্রাম্য মানুষের জীবন প্রণালীর মধ্য দিয়ে শতকের পর শতক ধরে গড়ে তোলা যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি তাই লোকসংস্কৃতি।

রবীন্দ্রনাথ লোকসাহিত্যকে ‘জনপদের কলরব’ বলে অভিহিত করেছেন। এই লোকসংস্কৃতি—লোকসাহিত্যের ‘লোক’ কথাটি লোকবিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেন। ‘লোক’ বলতে তাঁরা একান্ত গ্রামবাসী, সমাজ-উপেক্ষিত দিনমজুর, কৃষি ও অন্যান্য কর্মের সঙ্গে যুক্ত নর-নারী, খেটে খাওয়া মানুষগুলিকেই বোঝেন। এদের নৃত্য-গীত-ছড়া-ধাঁধা-প্রবাদ-নানা ধরনের শিল্প সৃষ্টি সাধারণ ভাবে লোকসংস্কৃতি নামে অভিহিত। সমগ্র রাঢ় অঞ্চল লোকসংস্কৃতির আকরভূমি। বিস্ময়কর ব্যাপার পশ্চিম প্রান্তিক রাঢ়ভূমির বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সুদীর্ঘকাল ধরে নিরক্ষরতার অন্ধকারে থাকলেও হারায়নি তাঁদের সৃজনক্ষমতা।

এই নিবন্ধে আমাদের আলোচ্য বিষয় লোকসংস্কৃতির বিশিষ্ট ধারা— প্রবাদ। বহুবিচিত্র প্রবাদের ছড়াছড়ি সমগ্র পশ্চিমরাঢ়ে। তাই বুঝি লোকে বলে ‘প্রবাদভূম রাঢ়ভূম’। আলোচনার পূর্বে প্রবাদ সম্পর্কে দু’চার কথা বলতে হয়। প্রবাদ হল, পরম্পরাগত বাক্য, জনশ্রুতি, জনরব বা কিংবদন্তী। ঠিক কবে প্রবাদের সৃষ্টি তা যেমন বলা যায় না, তেমনি প্রবাদের কোনও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করাও সম্ভব নয়। তবে প্রবাদ যে মানুষের অভিজ্ঞতা প্রসূত ফসল তাতে সন্দেহ নেই। মানবজীবনের আনন্দ-মধুর, বেদনা-বিধুর, তিক্ত ও রুক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল প্রবাদ। আর লোকসাহিত্যের সঞ্চরণযোগ্যতার গুণে শ্রুতি ও স্মৃতিকে নির্ভর করে সেগুলি লোকসাধারণের মুখচারণা করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে। প্রবাদ বিশেষ কোনও প্রণেতার প্রযত্ন-সম্ভূত সৃষ্টি নয়, মানুষের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অনুভূতির ফসল। সংক্ষিপ্ততা, সহজগম্যতা, বাস্তবতা, সরসতা প্রবাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে লুকিয়ে থাকে কিছুটা বক্রোক্তির ভাব। প্রবাদে প্রতিভাসিত হয় গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ-জীবনের কথা, মানুষের দীর্ঘসঞ্চিত অভিজ্ঞতার কথা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ পরিস্থিতির কথা, মানব ও মানবেতর প্রাণির প্রকৃতি বৈশিষ্ট্যের কথা। বস্তুত প্রবাদ মানুষের জীবনবোধ ও বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতার বাঙ্ময় রূপ। যেমন, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’, ‘উবগা(ই)রাকে বাটে মারে’, ‘কানা খড়া পিয়াদা, তিন মুড় জিয়াদা’ প্রভৃতি প্রবাদ প্রাত্যহিক জীবনেরই অভিজ্ঞতা প্রসূত।

পশ্চিমরাঢ়ে প্রচলিত প্রবাদসমূহের সঙ্গে বৃহত্তর রাঢ়ের অপরাপর অংশে প্রচলিত প্রবাদ-মালার ভাব ও বিষয়গত ভিন্নতা লক্ষিত না হলেও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা দৃষ্টিগোচর হয়। উপমা প্রয়োগ, উদাহরণ উপস্থাপনা, ব্যঙ্গ-বক্রোক্তির অভিনবত্ব, ভাষা-ভঙ্গিমা, উচ্চারণ বিশিষ্টতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যে এ গুলি অভিনব। পশ্চিম রাঢ়ে প্রচলিত প্রবাদ সমূহকে এই কয়েকটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে: কৃষি, ব্যক্তি চরিত্র, নারী প্রকৃতি, পরিবার পরিজন, পশুপাখি-জীবজন্তু ভিত্তিক।

কৃষি বিষয়ক: পশ্চিমরাঢ়ের মানবসাধারণের জীবনধারণের অন্যতম প্রধান অবলম্বন কৃষি— যা আবার অনেকাংশেই নির্ভরশীল প্রকৃতির বদান্যতার উপর। কখনও অনাবৃষ্টির কারণে তীব্র খরা, কখনও বা অতিবৃষ্টির ফলে পাহাড়ি নদীগুলির সর্বগ্রাসিতা জনজীবনকে করে তোলে বিপর্যস্ত। অসহায় মানুষগুলি উদ্বেগাকুল হয়ে ওঠে আগামী দিনের দুশ্চিন্তায়। সেই উদ্বেগের চিত্র প্রতিফলিত এ জাতীয় প্রবাদে। নিদর্শন: ‘অঙা গুণে পঙা, গাছ গুণে ঝিঙা’ (যেমন বীজ, তেমন তার চারা, তেমন তার ফলন। আবার নীচাশয় পিতা মাতা এবং তাদের দুষ্টমতি সন্তানকে ব্যঙ্গ করেও প্রবাদটির চল)। ‘শুনা কথা বুনা ধান, আধেক আগড়া আধেক ধান’ (উড়ো কথার সত্যতা যেমন কম তেমনি অকর্ষিত জমিতে ফসল ফলনের আশাও কম)।

ব্যক্তি চরিত্র বিষয়ক: মানব চরিত্রে নিহিত নানা সংগতি-অসংগতি, স্বার্থপরতা, ঈর্ষা-কুটিলতা, লোভ-লালসা প্রভৃতির শ্লেষাত্মক চিত্র প্রতিফলিত এজাতীয় প্রবাদে। নিদর্শন: ‘মুহের চোটে গগন ফাটে’ (বাগাড়ম্বর প্রবণতা), ‘উঁদুরে গাঢ়া করে, সাপে ঘর করে’ (একের শ্রমের ফল অপরে ভোগ করে)।

নারী-প্রকৃতি বিষয়ক: প্রবাদ মূলত নারী মনের সৃষ্টি এবং নারী মহলেই এর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার। এই শ্রেণীর প্রবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তীব্র ব্যঙ্গ, তীক্ষ্ম বক্রোক্তি, নারীর ত্রুটি-বিচ্যুতি, চটুল কৌতুক রস প্রভৃতি। নিদর্শন: ‘অকাজে বউড়ি দড়’ (অপ্রয়োজনীয় কাজে বধুর উৎসাহ)।

পরিবার পরিজন বিষয়ক: এই শ্রেণীর প্রবাদে পরিবার পরিজন, অনেকানেক আত্মীয় স্বজনের প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য ও নানা অসংগতির ভাব প্রকাশিত। নিদর্শন: ‘দিলে থুলেই চুচকা মাসি /না দিলেই সব্বনাশী’ (যতক্ষণ স্বার্থ, ততক্ষণই সম্পর্ক; স্বার্থে হানি ঘটলেই সম্পর্ক নষ্ট)। ‘কুঁড়া খাঁ(ই)য়ে ম(ই)রল বাপ, তার ব্যাটার বিদ্দাপ’ (দরিদ্র পিতা কষ্টে দিন চালায় আর পুত্র বড়লোকি ঠাট দেখায়)। ‘মায়ের গলায় পুয়াল দড়ি, মাগের বেলায় সোনার বেড়ি’ (জননীর প্রতি উপেক্ষা এবং স্ত্রীর প্রতি দরদ দেখানো অর্থে)।

পশুপাখি, জীবজন্তু ভিত্তিক: এ জাতীয় প্রবাদে ইতর প্রাণীর রূপকে মানব চরিত্রের নানা অসংগতির সঙ্গে তুলনা করা হয়। নিদর্শন: ‘আঘাল বগলির পুঁটি তিতা’ (পেট ভর্তি থাকায় উপাদেয় খাদ্য বস্তুকেও খারাপ বলা)। ‘আঁধড় কুকুর বাতাসে ভুকে’ (ভিত্তিহীন গুজবকে প্রচার করার প্রবৃত্তি)। ‘উই, উঁদুর, কু-জন/গড়া ভাঙে তিনজন (উই পোকা এবং ইঁদুরের মতো কুপ্রবৃত্তির মানুষও ক্ষতিকারক)। ‘খুঁটির জোরে কাড়া লাচে’ (প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে মোড়লি করা অর্থে)।

লোকসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধারা এই প্রবাদ। এগুলিতে প্রতিফলিত অতি প্রখর বাস্তববোধ ও জীবনসঞ্জাত অনুভূতি। সমগ্র পশ্চিমরাঢ়ে নানা ধরনের প্রবাদের ছড়াছড়ি। লোকশিক্ষার মাধ্যম হিসাবেও এগুলি মূল্যবান। উল্লেখ্য, ‘ধন যৈবন আড়াই দিন, চামের চ(ই)খে মানুষ চিন’ প্রভৃতি প্রবাদ আপ্তবাক্যের মতোই মূল্যবান। মানুষের মুখে মুখে ফেরে এজাতীয় প্রবাদ। এগুলি বেঁচে আছে প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতার গুণে, রচনার সরসতার গুণে, ভাষার সাবলীল স্বচ্ছতার গুণে।

লেখক প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

Proverb Folk Culture Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE