Advertisement
E-Paper

প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কাজের প্রতিবাদ মানেই দেশদ্রোহ?

মনে আছে তো দিল্লি পুলিশকর্তাদের, পুলিশের কাজে যোগ দেওয়ার সময় কী শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা? 

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share
Save

জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদ নিজে আন্দোলন করেছেন এত কাল, এখন তাঁকে নিয়ে কোনও আন্দোলন হবে কি? যদিও করোনাকালে আন্দোলন মানে সমাজমাধ্যমে ‘উমর খালিদ, সঙ্গে আছি’, এইটুকুই। দিল্লিতে অবশ্য একটা প্রেস কনফারেন্স হয়েছে। দিল্লি নৃশংসতার (দাঙ্গা নয়, দাঙ্গা বলে দ্বিপাক্ষিক হিংসাকে) সময় শহরে উপস্থিত না-থাকা সত্ত্বেও তার দায়ে উমর খালিদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (আনল’ফুল অ্যাকটিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট) দিয়ে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনতে দেখে স্তম্ভিত যাঁরা, তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে। প্রশান্ত ভূষণ এই চার্জশিটকে বলেছেন ‘ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি’। কানহাইয়া কুমার-সহ অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কোথায় সেই বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বা কপিল মিশ্রদের নাম, যাঁরা খোলাখুলি দিল্লি নৃশংসতায় উসকানি দিচ্ছিলেন? প্রতিহিংসা ছাড়া সম্ভবত এই চার্জশিটের কোনও ব্যাখ্যা নেই। দিল্লি নৃশংসতায় যাঁরা প্রকাশ্যেই হিংসাত্মক উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের বদলে চার্জশিটে দেখা যাচ্ছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের নাম।

এরই মধ্যে অভূতপূর্ব কাণ্ড। নয় জন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার দিল্লি পুলিশ কমিশনার শ্রীবাস্তবকে খোলা চিঠি লিখলেন‌ যে, এই চার্জশিটের মধ্যে ন্যায্য তদন্তের ছায়াও নেই! লিখলেন, ‘‘ভারতীয় পুলিশের ইতিহাসে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যময় দিন আজ।’’ ‘‘এ ভাবে ‘সংখ্যাগুরুবাদের মনোভাব’ নিয়ে ন্যায়বিচারের নামে চূড়ান্ত অন্যায় ঘটল— ‘ট্র্যাভেস্টি অব জাস্টিস’! বোঝাই যাচ্ছে যারা আসল অপরাধী তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যাবে।’’ প্রসঙ্গত, এই সিনিয়র অফিসাররা কেউই ঠিক কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আনা কণ্ঠ নন, সকলেই ‘কনস্টিটিউশনাল কনডাক্ট গ্রুপ’-এর সদস্য। এর প্রধান— পদ্মভূষণ প্রাপ্ত জুলিয়ো ফ্রান্সিস রিবেইরো, এক কালের মুম্বই পুলিশ কমিশনার, ডিজিপি পঞ্জাব ও ডিজিপি গুজরাত, তাঁর মতে— ‘‘যে সব কথা বিজেপি নেতারা বলেছেন, কোনও মুসলিম বা বামপন্থী তা বললে অবশ্যই তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে জেলে পোরা হত।’’ তিনি জানতে চেয়েছেন, মনে আছে তো দিল্লি পুলিশকর্তাদের, পুলিশের কাজে যোগ দেওয়ার সময় কী শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা?

অতীব কড়া বার্তা। এর আগে বিচারবিভাগের ভিতর থেকে উঠে আসা আত্ম-ভর্ৎসনা শুনেছি আমরা, এ বার শুনছি পুলিশের ভিতর থেকে। আশা করতে ইচ্ছে করে, উমর খালিদকে নিয়ে অন্তত আরও ক’টা দিন এই সব কথা চলবে। নাগরিক নীরবতা ও বিস্মৃতির বিভ্রমে তলিয়ে যাওয়ার আগে আর একটু তোলপাড় হবে!

‘আশা’ই। কেননা, হয়তো উমর খালিদের সূত্রে আরও অনেকের কথা উঠে আসবে আমাদের বিভ্রান্ত মানসপটে। সেই অন্যরা, যাঁদের নাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক ঘটনা-আবর্তের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যেমন, ছাব্বিশ বছরের তরুণী কাশ্মীরি চিত্র-সাংবাদিক মাসরাত জ়াহরা। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ভাবে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হন তিনি। যেমন, দ্য হিন্দু পত্রিকার রিপোর্টার পিরজ়াদা আশিক, ধরা পড়েন ইউএপিএ-তে, কাশ্মীরের খবর ‘কভার’ করে!

কিংবা, সিএএ-প্রতিবাদী কলেজপড়ুয়া সাফুরা জ়ারগার, মিরান হায়দর, শারজিল ইমাম। এঁদেরও সম্প্রতি ধরা হয়েছে ইউএপিএ ধারায়। নামগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনলে এক বিরাট অংশের মানুষ এক কথায় তা বিশ্বাস করবেন। আর যাঁরা বিশ্বাস করার আগে তথ্যপ্রমাণ চাইবেন, তাঁরা এই করোনা-আবহে হারিয়ে যেতে বসেছেন! অবশ্য তথ্যপ্রমাণ চাইলেই বা কী। প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা এবং দলিত-মার্ক্সবাদী লেখক-সমাজকর্মী আনন্দ তেলতুম্বডের কথা তো শুনছি কত বারই— তেমন প্রমাণ ছাড়াই যাঁরা দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত। ‘পদ্মশ্রী’-ভূষিত সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধেও ১২৪-এ ধারার (দেশদ্রোহিতা) অভিযোগ। কেন দেশদ্রোহ? দুয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কোভিড-ম্যানেজমেন্ট খুব খারাপ। সিধে হিসেব, সোজা রাস্তা।

হিসেবটা সত্যিই সিধে। মোদী মানেই দেশ, তাঁর সমালোচনা মানেই দেশের সমালোচনা, আর দেশের সমালোচনা মানেই দেশের প্রতি দ্রোহ কিংবা সন্ত্রাস। (অবশ্যই মনে রাখব আমরা, সব প্রধানমন্ত্রী মানেই ‘দেশ’ নয়, ‘দেশ’ কেবল এক জনই। তাই মনমোহন সিংহের নামে বাঁকা কথা চলতেই পারে, নেহরু বা ইন্দিরা তো সত্তর বছরের সব দুর্দৈবের জন্যই দায়ী!)

কিসে দেশের মুখ নিচু হয়, কিসে দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ঘোষণা করা হয়— ইউএপিএ কিংবা এনএসএ-র মতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগই বুঝিয়ে দেয়। এই যেমন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচে এক জন গ্রেফতার হলেন। সন্দেহ: তিনি নাকি গরু হত্যায় জড়িত। এই প্রসঙ্গে সামনে এল ভারী চমকপ্রদ তথ্য: এ বছর উত্তরপ্রদেশে এনএসএ-তে যে ১৩৯ জনকে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৬ জনই গোহত্যার অভিযোগে ধৃত! গরু যে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে গভীর ও মৌলিক ভাবে যুক্ত, সেটা এতই সহজ কথা যে, এ নিয়ে বিশেষ কেউ মাথাও ঘামাননি, সমাজমাধ্যম-সংবাদমাধ্যমে ঝড়ও বয়ে যায়নি!

এই সবই ঘটছে করোনা-কালের ভারতে। এখন মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, চাকরি বাঁচাতে উদ্বিগ্ন। এই সব সময়ে চেঁচামেচি করতে কাঁহাতক ইচ্ছে করে! সংসদের ক্লাসেও আজকাল প্রশ্ন করা বারণ, মন্ত্রীদেরও স্পিকার মশাই কথা বলতে দেন না, বিরোধীরা কোন ছার। সংসদের বাইরে বিরোধী নেতানেত্রীরা যেটুকু হাঁকডাক পাড়েন, সে সব ‘এমনিই এসে ভেসে যায়’। এমতাবস্থায় ছাত্র-সাংবাদিক-সমাজকর্মী গরু-খাদক গরু-বিক্রেতাদের জামিন-বিহীন জেলে পুরলে অনেক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। তা ছাড়া যাঁদের ধরা হচ্ছে না, তাঁদেরও পষ্টাপষ্টি বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে— ভয়ের ফাঁদ পাতা ভুবনে! গরুর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জুড়ে ঠিক এটাই জানাতে চান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। একের পর এক সিএএ-বিরোধী নেতাকে চার্জশিট দিয়েও এটাই বলতে চান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

ভয় যদি তুরুপের তাস হয়, খুবই কাজের জিনিস ইউএপিএ, সন্দেহ নেই। তাই দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা পেয়েই এই আইনের পরিসর অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মোদী, যাতে নানা রকম ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যায়। ইউএপিএ সংশোধনী বিল এসেছিল ২০১৯ সালের অগস্টে। মনে পড়ে, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন। এনডিএ-র বিরাট সংখ্যার জোয়ার কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই প্রতিবাদ!

দুটো নতুন কথা যোগ হয় সংশোধনীতে। এক নম্বর, যে সব কেস রাজ্য সরকারের পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে, সেখানেও ‘প্রয়োজনবোধে’ এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) প্রধান ভূমিকা পালন করবে। দুই নম্বর— যেটা গণতন্ত্রের পক্ষে আরও বেশি মারাত্মক— শুধু গোষ্ঠী বা সংস্থা নয়, যে কোনও একক ‘ব্যক্তি’কেও এ বার সন্ত্রাসবাদী বলে অভিযুক্ত করা যাবে। লোকসভায় অমিত শাহ একটি অসাধারণ বৃত্তাকার যুক্তি দিলেন— সন্ত্রাসবাদী ধরার এই ব্যবস্থায় আপত্তি করতে পারে কেবল সন্ত্রাসবাদীরাই। অর্থাৎ এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ=আপত্তি=সন্ত্রাস, সুতরাং তাকে ধরার জন্য এই আইন। নিপাট বৃত্ত যাকে বলে।

সংশোধনীতে রইল আরও একটা কথা। কেউ যদি কোনও ভাবে সন্ত্রাসকে পোষণ করে কিংবা সাহায্য করে, সে তবে সন্ত্রাসবাদী: ‘হু হেলপস প্রোমোট অর প্রিপেয়ার ফর টেররিজ়ম’। মানেটা বোঝা দরকার। আসলে, কোথায় যে বাক্‌স্বাধীনতার শেষ, কোনটা সরকার বা রাষ্ট্রের বিরোধিতা, আর কোনটা বিচ্ছিন্নতাবাদ বা দেশদ্রোহ, এ সবের মধ্যেকার সীমারেখা নিয়ে দেশে বিদেশে, পুরনো নতুন গণতন্ত্রে, আমেরিকায় ব্রিটেনে ভারতে তর্কবিতর্ক প্রচুর, গভীর, ব্যাপক, জটিল। তারই মধ্যে ২০১৫ সালের মার্চে (মোদীর শাসনকালের গোড়াতেই) ‘শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ ঠিক এমনই একটা ‘প্রতিবাদ না কি সন্ত্রাস’ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দেয়। বলা হয়, বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যে তিনটে ধারণা: আলোচনা (ডিসকাশন), পরামর্শ (অ্যাডভোকেসি) এবং উসকানি (ইনসাইটমেন্ট)—শেষটি ছাড়া কোনও কিছুই ১৯(২) ধারার আওতায় ফেলে পাবলিক অর্ডার ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা যাবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ— ইনসাইটমেন্ট বা উসকানি সুদূর বা পরোক্ষ হলেও সেটা অপরাধ বলে ধরা যাবে না। কারও কথা বা কাজ হিংসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হলেই (বারুদের মধ্যে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলার মতো) কেবল তাকে এই ধারায় ফেলা যাবে।

এই ১৯(২) ধারার সঙ্গেই ইউএপিএ যুক্ত, তাই এই ইতিহাসটা এখানে অত্যন্ত জরুরি। একটি বহুসংস্কৃতির দেশে, গণতন্ত্রের দেশে, সর্বোচ্চ আদালতের ওই দিগদর্শনটি ছিল স্পষ্ট, ঋজু আর বিবেচনাসম্পন্ন। ২০১৯ সালের ইউএপিএ সংশোধনীর মাধ্যমে মোদী-শাহ সুপ্রিম কোর্টের এই দিগদর্শনকেই বরবাদ করেছিলেন। তার পর থেকে নতুন দেশদ্রোহ ধারায় চলছে মোদীজির নতুন দেশ।

করোনা চলছে। চলছে ইউএপিএ-ও। ভারত আমার ভারতবর্ষ, মৃত্যুসন্তপ্ত রোগসন্ত্রস্ত বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত। বিপর্যয় তো কেবল রোগে নয়, তার আড়াল দিয়ে লুকিয়ে চলা আরও অনেক কিছুতেই। দিল্লি চার্জশিটের সূত্রে সে সব কি মনে পড়ল কিছুটা? সামান্য উসখুসও কি হল কোথাও?

Narendra Modi Delhi Riot Sedation

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।