ছবি: সংগৃহীত
হিন্দি চাপিয়ে দিলে পাঠ্যক্রমে অন্য ভাষার গুরুত্ব কী ভাবে বা কতখানি কমবে, আদৌ কমবে কি না, তা এখনও সরকারি ভাবে স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয় এনডিএ সরকার তৈরির পরেও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে হিন্দি-শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব উঠেছিল। সঙ্গে হয়েছিল প্রবল বিরোধিতাও।
এ বারেও ‘হিন্দি দিবসে’ একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করেও বিরোধিতার ছবি দেখা গিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই বিরোধিতার প্রবণতাগুলিকে আমরা দু’টি মোটা দাগে ভাগ করতে পারি।
প্রবণতা এক: হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা। ভাষা নিশ্চিত ভাবেই মানুষের পছন্দ। সেই সূত্রে তা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত ভাবে মানুষের অধিকার ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সঙ্গে যুক্ত। সেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের গণ্ডিতে ‘অনধিকার’ প্রবেশের মধ্যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর রয়েছে কি না, তা-ও বিচার্য। একই রকম ভাবে কোনও বিশেষ ভাষাকে কেন্দ্র করে এমন চাপানোর চেষ্টা ‘ভাষাগত সাম্রাজ্যবাদের’ এক চিন্তিত সংরূপ কি না, তা-ও বিচার্য।
প্রবণতা দুই: হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা স্বাভাবিকই। কিন্তু সেই বিরোধিতার অভিমুখ মাঝেসাঝেই ঘুরে যাচ্ছে হিন্দি ভাষা ও হিন্দি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত মানুষদের বিরোধিতায়। তৈরি হচ্ছে অপরের ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করার ‘সাংস্কৃতিক অহং’-এর প্রবণতা। হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াসটির মতোই এই ‘অহং’টিও সমান চিন্তার।
দ্বিতীয় প্রবণতাটি সারবত্তাহীন কেন, তা আমাদের আলোচ্য। মনে পড়তে পারে, ‘বিশ্বভারতী’ পত্রিকার দশম বর্ষ সংখ্যায় ‘বাংলা বৈষ্ণব-সাহিত্য ও হিন্দী বৈষ্ণব-সাহিত্য’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অধ্যাপক শশিভূষণ দাশগুপ্ত। তাঁর লেখায় এই দুই ভাষায় রচিত পদ-সাহিত্যের অমিল ও মিল দুইই দেখানো হয়েছে।
প্রথমে অমিলের প্রসঙ্গ। শশিভূষণ লিখেছিলেন হিন্দি বৈষ্ণব কবিদের, বিশেষত বল্লভী সম্প্রদায়ের ‘অষ্টছাপ’ কবিদের মুখ্য সাহিত্যিক অবলম্বন ‘ভাগবতপুরাণ’ বর্ণিত কৃষ্ণলীলা। কৃষ্ণলীলা বর্ণনায় হিন্দি বৈষ্ণব পদে মধুররসের পাশাপাশি, সমগুরুত্ব শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্যেরও। অথচ, যেখানে প্রেমলীলার প্রসঙ্গ এসেছে সেখানেই কবিতা হয়ে উঠেছে আশ্চর্য সুন্দর। শশিভূষণ উদ্ধৃত করেছেন মীরার একটি অপূর্ব পদ। মীরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের অনুগামী নন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা যেমন তত্ত্বগত ভাবে সখীভাবে দূর থেকে বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের নিত্যলীলার প্রত্যক্ষদর্শী হতে চান, মীরাতে তেমনটা নেই। প্রেমের প্রকাশে মীরা নিজেই রাধার স্থান অধিকার করে নিয়েছেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবের সঙ্গে দার্শনিক স্বাতন্ত্র্য রেখেই মীরার এই সৃষ্টি।
এ বার মিলের প্রসঙ্গ। গৌড়ীয় বৈষ্ণবের কৃষ্ণ ও রাধার সঙ্গে ভক্তের দূরত্ব বজায় রেখে পদরচনার যে রীতি, ক্রমে তা ঢুকে পড়ে হিন্দি বৈষ্ণব কবিতাতেও। সুরদাসের একটি পদে দেখা যাচ্ছে, হিন্দি বৈষ্ণব কবিও দূর থেকে রাধা-কৃষ্ণের ব্রজলীলার দর্শক হয়ে উঠছেন। সেখানে রয়েছে, ‘রাধা মাধব, মাধব রাধা, কীট-ভৃঙ্গগতি হোই জো গঈ’ অর্থাৎ রাধাই কৃষ্ণ, কৃষ্ণই রাধা, কীট আর ভ্রমর যেন একাকার হয়ে গিয়েছে। প্রেমের এমন এক স্তরের কথা বলছেন সুরদাস যেখানে নারী-পুরুষ নিজের অস্তিত্ব বিভ্রমে আবিষ্ট। আর ঠিক এ জায়গাতেই মনে পড়তে পারে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবের মহাগ্রন্থ ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ ‘প্রেমবিলাসবিবর্ত’ প্রসঙ্গে রায় রামানন্দের মুখ থেকে রাধার বয়ানে শোনা পদাংশ, ‘ন সো রমণ, ন হাম রমণী’ (না সে পুরুষ, না আমি নারী)! ভাষা এবং তাকে কেন্দ্র করে এই দার্শনিক ধারণার পারস্পরিক যে চলন— এটাই আসলে ভারতীয় সাহিত্যের আসল ভাষা-মানচিত্র।
এই মানচিত্রের বিস্তার উনিশ, বিশ শতক পেরিয়ে আজও হয়ে চলেছে। আর তাই, উনিশ শতকে বাংলায় রচিত ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’-এর অনুবাদ হচ্ছে মরাঠিতে। ঈশপ-কাহিনির ‘বালবোধ মুক্তাবলী’ নামে প্রথমে মরাঠিতে, পরে ‘নীতিকথা’ নামে অনূদিত হচ্ছে বাংলায়। বিশ শতকে ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’-এ শঙ্খ ঘোষের সূত্রে জানা যায়, অবলীলায় মরাঠি কবি দিলীপ ছিত্রে বলে চলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শক্তি চট্টোপাধ্যায় থেকে ‘মুক্তিবোধ’, নিরালার কথা। আবার, প্রয়াগ শুক্ল সরাসরি বাংলা থেকেই হিন্দিতে অনুবাদ করেন জীবনানন্দের কবিতা।
এখন প্রশ্ন, বিরোধিতার যে দ্বিতীয় প্রবণতাটি, তার মধ্যে বাঙালির অন্য ভারতীয় ভাষার প্রতি নাকউঁচু ভাবটাই কি ফুটে উঠছে? এ জন্যই বোধহয়, অমিয় চক্রবর্তী অন্য প্রাদেশিক সাহিত্য সম্পর্কে বাঙালির ঔদাসীন্য দেখেছিলেন। তবে, এই উদাসীনতার মাঝেও বাঙালির গর্বের ঐতিহ্যও রয়েছে। ১৯৩৬-এ লখনউতে ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ’-এর প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন মুনশি প্রেমচন্দ। এরই সূত্র ধরে কয়েক বছর পরে তৈরি হয় ‘বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ’। ১৯৬৫-তে অন্ধ্রপ্রদেশের পাঁচ জন তেলুগু কবি প্রতিষ্ঠিত ‘দিগম্বর গোষ্ঠী’র কবিতার সঙ্গে অনুরূপ বাংলা বা হিন্দি কবিতাকে মিলিয়ে পড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন শঙ্খবাবু।
আজ বাঙালি ভাষাগত ভাবে হিন্দির ‘চাপানোর চেষ্টার’ বিরোধিতা করতে গিয়ে যদি এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলি বিস্মৃত হয়, তা হলে এক ভাবে নিজের অস্তিত্বের, প্রকাশের একটা অংশকেই নাকচ করছে। প্রতিটি ভারতীয় ভাষার মতোই বাংলা সাহিত্যের শরীরেও নানা ভাষার আদর-আবদারের দাগ রয়েছে। অন্য ভাষাতেও বাংলার অস্তিত্ব প্রকাশ ঘটেছে। আর তাই শিশিরকুমার দাশের এক সময় মনে হয়েছিল, মরাঠি, তামিল, তেলুগু, বাংলা, হিন্দি, অসমিয়া, ওড়িয়া, গুজরাতি ইত্যাদি ভারতীয় ভাষার সাহিত্যের যোগফল ভারতীয় সাহিত্য নয়। ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস রচনার অর্থ প্রত্যেকটি ভারতীয় ভাষার মধ্যে এই যোগাযোগের ইতিহাস রচনা করা।
কবীর সংস্কৃতকে তুলনা করেছিলেন কূপজলের সঙ্গে, আর ভাষাকে বলেছিলেন বহতা জলধারা। বহতা জলধারায় স্বাভাবিক ভাবেই কালে কালে নানা উপাদান মেশে। আর তাই, বিরোধিতার মধ্যে ‘প্রকৃত’ ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ভুলে যাওয়া যেন না থাকে। এ প্রসঙ্গে এ-ও বলা যায়, হিন্দি ভাষাটি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আগ্রাসী রাজনীতির অংশ। কিন্তু সেই চেষ্টার বিরোধিতা হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যকে যেন কোনও ভাবেই অসম্মান না করে। আর যদি তা হয়, তবে হিন্দি চাপানোর যে রাজনৈতিক এবং সরকারি চেষ্টা, তার সঙ্গে মতাদর্শগত ভাবে খুব একটা বিরোধিতা থাকবে না বাঙালির।
তবে একটাই ভরসা। বাঙালি শেষ পর্যন্ত বোধ হয় আত্মবিস্মৃত নয়!
বাংলার শিক্ষক, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy