গ্র্যান্ডমাস্টার রমেশবাবু। —ফাইল চিত্র।
সাল ২০১৩। দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে চেন্নাইয়ে। মুখোমুখি বিশ্বনাথন আনন্দ, ম্যাগনাস কার্লসেন। পাঁচতারা হোটেলের লবিতে ঘুরঘুর করছে বছর আটেকের এক বালক আর বিড়বিড় করছে, “আমিও এক দিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হব।”
কে জানত, সেই বালক মোটেও দিবাস্বপ্ন দেখছে না। তিন বছরের মধ্যেই বিশ্বের কনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসাবে ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হবে! মাত্র দশ বছর ন’মাস বয়সে। তার দু’বছরের মধ্যে ভারতের কনিষ্ঠ এবং বিশ্বের দ্বিতীয় কনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। বারো বছর দশ মাস বয়সে। বিশ্বনাথন আনন্দ যখন ভারতের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হচ্ছেন, তাঁর বয়স আঠারো।
চেন্নাইয়ে সে বার আনন্দকে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হন কার্লসেন। বাক্স গুছিয়ে যখন নরওয়ে ফিরে যাচ্ছেন, তখনও কি ভাবতে পেরেছিলেন, হোটেলের লবিতে ঘুরে বেড়ানো এক বালক এক দিন তাঁর ‘চ্যালেঞ্জার’ হয়ে দেখা দেবে!
অনলাইন র্যাপিড দাবায় তাঁকে হারিয়ে চমকে দেবে! বিশ্বকাপ দাবার ফাইনালে তাঁর প্রতিপক্ষ হবে!
রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। দক্ষিণী প্রথা অনুযায়ী, রমেশবাবু তাঁর বাবার নাম। বাঙালি মতে যেমন পরে পদবি আসে, এ ক্ষেত্রে তা নয়। প্রজ্ঞানন্দই তাঁর নাম। ইংরেজি বানান করতে গিয়ে অনেকেই হোঁচট খায় (Praggnanandhaa)। এক সময় যেমন পি টি উষার পুরো নাম কুইজ়ের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাবা বিশ্বে যদিও সকলের মুখে মুখে ঘুরছে এই নাম— প্রজ্ঞানন্দ। ভারতীয় খেলাধুলার ইতিহাসে সচিন তেন্ডুলকরের পর এমন আলোড়ন ফেলে দেওয়া বিস্ময় বালক আর আসেনি।
সম্প্রতি ফিডে দাবা বিশ্বকাপে বিশ্বের দুই ও তিন নম্বরকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠেন প্রজ্ঞানন্দ। খেতাবি লড়াইয়ে কার্লসেনের কাছে টাইব্রেকারে হেরে গেলেও চোখে চোখ রেখে লড়াই করে জিতে নেন বিশ্বের প্রশংসা। ১৮ বছর বয়সে বাকুতে জিতলে তিনি দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব অর্জন করতেন। ববি ফিশার ও কার্লসেন জেতেন ১৬ বছর বয়সে।
বিশ্বকাপ জেতা মানেই যদিও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়। তবে সেরার হাইওয়েতে ঢুকে পড়া তো বটেই। এর পর ক্যান্ডিডেট্স। বিশ্বের আট জন সেরা প্রতিযোগী যোগ দেবেন। বাকুর বিশ্বকাপে প্রথম তিন স্থানাধিকারী যোগ্যতা অর্জন করল। প্রজ্ঞানন্দ তাঁদের এক জন, এটাই তো বিরাট কৃতিত্বের। বিশ্বকাপের মতো আরও কতকগুলি যোগ্যতা অর্জনকারী প্রতিযোগিতা রয়েছে। সেখান থেকে বাকিরা আসবেন। ক্যান্ডিডেট্স যিনি জিতবেন, বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুখোমুখি হবেন। সেই শীর্ষ দ্বৈরথে যিনি জিতবেন, তিনিই বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! ভারত থেকে একমাত্র আনন্দ সেই মুকুটের অধিকারী। তিনি পাঁচ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন চিনের ডিং লিরেন। ক্যান্ডিডেট্স যদি জিততে পারেন প্রজ্ঞা, তিনিই লিরেনের ‘চ্যালেঞ্জার’।
গত কয়েক বছরে নিঃশব্দে দাবা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে ভারতে। আর তার নেপথ্যের কারিগর বিশ্বনাথন আনন্দ। তাঁর স্কুল থেকেই একের পর এক কৃতী ছাত্র বেরোচ্ছে। কিশোর সচিনকে যেমন প্যাড পাঠিয়ে উৎসাহিত করেছিলেন সুনীল গাওস্কর, তেমনই কনিষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পরে প্রজ্ঞাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়ান আনন্দ। তার পর থেকে সব সময় পথপ্রদর্শক হিসাবে পাশে রয়েছেন। প্রজ্ঞানন্দ তো বটেই, আর এক জনকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত দাবা মহল। এন গুকেশ। ফিডে র্যাঙ্কিংয়ে সব চেয়ে উপরে থাকা ভারতীয়। আট নম্বর। আনন্দ নয়ে। প্রজ্ঞানন্দের বিশ্ব র্যাঙ্কিং ২২, কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠার পরে নিশ্চয়ই উপরে উঠবেন। এই মুহূর্তে ফিডে র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম একশোর মধ্যে আট জন ভারতীয়। বিশ্বকাপে আট জন কোয়ার্টার ফাইনালিস্টের মধ্যে চার জন ছিল ভারতীয়।
আর এই বিপ্লবের সেরা মুখ প্রজ্ঞানন্দ। যাঁর দাবায় আগমন নিছকই কাকতালীয়। দিদি বৈশালী টিভিতে বেশি মন বসাচ্ছে দেখে দাবায় ভর্তি করে দেন বাবা রমেশবাবু। সেই দেখাদেখি প্রজ্ঞাকেও দাবা ক্লাসে ভর্তি করানো। দু’জনেরই জীবন হয়ে দাঁড়াল দাবা বোর্ড। এখন বৈশালীই ভাইয়ের দাবা-অভিভাবক। বাবা পোলিয়োয় আক্রান্ত হয়েও জীবনযুদ্ধে হার মানেননি। চাকরি করে গিয়েছেন, যাতে ছেলে-মেয়ের স্বপ্ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। বাবার চোয়াল শক্ত করা লড়াই আর মা নাগলক্ষ্মীর লাজুক সারল্য পেয়েছেন প্রজ্ঞা। মায়ের হাতের দক্ষিণ ভারতীয় রান্না খেয়েই প্রজ্ঞা বসেন কার্লসেনদের চমকে দেওয়া সব চাল দিতে।
এই বয়সে ভিডিয়ো গেমে পড়ে থাকে ছেলেমেয়েরা। আর তিনি বিশ্বজয় করতে বেরিয়ে পড়েছেন। মস্তিষ্ক চালনা দেখে কে বিশ্বাস করবে বয়স ১৮! মনে হবে ৪৮-এর ঠান্ডা মাথা— কী দাবার বোর্ডে, কী ব্যক্তিগত জীবনে। এক বার বিমানবন্দরে ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছেন না মা। তার পর দেখেন, টিভির সামনে দাঁড়িয়ে তামিলনাড়ুর নির্বাচনী ফলাফল গিলছে। তখনও তিনি ভোটারই হননি, কে বলবে!
বছর দুই আগে কার্লসেনকে হারানোর পরে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে অবাক হতে হয়েছিল। পাঁচ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হারিয়েছেন। জায়ান্ট-কিলার তিনি। অথচ গলায় উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটা নেই। বলে দিলেন, “ভাল জিতেছি। কিন্তু লম্বা যাত্রা বাকি।” লক্ষ্য কী? “বিশ্বসেরা হওয়া।” একটুও আমতা-আমতা না করে জবাব দিলেন। চেন্নাইয়ের হোটেলে ঘুরঘুর করা সেই ছেলেটার মতোই লক্ষ্যে স্থির।
অর্জুন যেমন শুধু পাখির চোখ দেখছিলেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy