সালটা ২০১৪, ফেব্রুয়ারি মাস। শুনলাম, অফিসের কাজে যেতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনার অন্তর্গত গ্রিনভিলে। ছোটবেলা থেকে ফেলুদা-পাঠের ফলে কোথাও যাওয়ার আগে জায়গাটা নিয়ে একটু লেখাপড়া করে নেওয়ার অভ্যাস আছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য জায়গাটা নতুন ছিল না, আগে গিয়েছি। তাই শুধু ভাল করে দেখলাম আবহাওয়ার ব্যাপারটা। দেখলাম, প্রবল তুষারপাতের সম্ভাবনা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সে কথা জানিয়ে যাওয়ার সময়টা একটু পিছিয়ে দিতে বললাম। তাঁরা গা করলেন না, অতএব গেলাম।
গিয়ে মনে হল, না পিছিয়ে ভালই হয়েছে। চমৎকার ঝকঝকে আকাশ, কোথায় তুষারপাত! ঠান্ডা আছে, কিন্তু তা বাগে আনা কঠিন নয়। দু’দিন কাজে-কর্মে কাটল বেশ। তার পর শুনলাম, পরের দিন থেকে টানা তিন দিন ওখানকার অফিস বন্ধ, কারণ তুষারপাত হবে প্রবল মাত্রায়। বন্ধ থাকবে স্কুল, শপিং মল— একেবারে ‘লকডাউন’।
এমনিতেই উত্তর আমেরিকার একেবারে দক্ষিণে তেমন তুষারপাত হয়নি কোনও দিন। তার ওপর এত সুন্দর নীল আকাশ যে এর মধ্যে তুষারপাতের আশঙ্কায় একেবারে লক-ডাউন— বাড়াবাড়ি ঠেকল। আমি আর এক সহকর্মী গিয়েছিলাম, আমরা সাহেবদের অতিমাত্রায় সতর্কতাকে নানা বিশেষণে বিশেষিত করে হোটেলে ফিরলাম। পর দিন বেলা করে ঘুম ভাঙল। পর্দা সরিয়ে দেখি, সব জানলার কাচ অস্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে। জানালা একটু ফাঁক করে মুখ আপনা থেকেই হাঁ হয়ে গেল। কোথায় গ্রিনভিল, এ তো সাইবেরিয়ার গভীরে এসে পড়েছি! মাটিতে অন্তত তিন-সাড়ে তিন ফুট পুরু বরফ, আর তা পড়েই চলেছে পেঁজা তুলোর মতো। আগের রাতে করা রসিকতাগুলো মনে পড়ল।
তিন দিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে খুবই ক্ষতি হয়েছিল আমাদের। পূর্বাভাস মেনে কয়েক দিন পরে যাওয়াই উচিত ছিল। আসলে পূর্বাভাস নিয়ে এটাই আমাদের মানসিকতা। আমাদের দেশে আবহাওয়া দফতরকে নিয়ে একটা রসিকতা সবাই শুনেছেন। আর কে লক্ষ্মণের একটি কার্টুন ছিল: এক বাস-স্ট্যান্ডে বৃষ্টির মধ্যে সবাই ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। শুধু এক বেচারা ভদ্রলোক ভিজছেন, কারণ তাঁর কাছে ছাতা নেই। সবাই তাঁকে ঠাট্টা করে বলছে— তুমি নিশ্চয় আবহাওয়া দফতরে কাজ করো, তাই বৃষ্টি হবে না এ কথায় বিশ্বাস করেছ?’
সাম্প্রতিক ঝড় আমপানে পশ্চিমবঙ্গের চার জেলা বিপর্যস্ত। বলতে গেলে তছনছ হয়ে গিয়েছে। চার দিন কেটে গেলেও বহু জায়গাতেই না আছে আলো, না আছে পানীয় জল। নেই কেবল, ইন্টারনেটও। একটা কথা শুনছি— যে হেতু কোভিড-১৯’এর কারণে লকডাউন, তাই কর্মীরা না থাকায় পরিষেবা ফেরাতে সময় লাগছে। কথাটা ভুল, তা বলছি না— কিন্তু কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সতর্কবার্তা কি ছিল না?
এই ধরনের ট্রপিকাল সাইক্লোনের পূর্বাভাসের ব্যাপারটা কিন্তু খুব নতুন নয়। প্রথম এই ধরনের পূর্বাভাসের যে নথি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল উইলিয়াম রিড প্রথম এ রকম পূর্বাভাস করেন বার্বেডোসে। ১৮৪৭ সালে। রিড মূলত ব্যারোমিটারের পারদ ওঠা-নামা দেখে এই সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। এর পর ১৮৭০ সালে বেনিটো ভাইন নামে এক ব্যক্তি মেঘের ঢাকনার তারতম্য বিচার করে সাইক্লোনের পূর্বাভাস দেওয়ার এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন হাভানাতে। তবে এ ব্যাপারে সত্যিকারের উন্নতি হয় রেডিয়ো আবিষ্কারের ফলে। ১৯৪৩ সালে আমেরিকা তৈরি করে ‘হারিকেন হান্টার’। এটা এক ধরনের প্লেন, যা নিয়ে পাইলট সরাসরি হারিকেনের মধ্যে প্রবেশ করতেন। ষাট ও সত্তরের দশকে প্রথম স্যাটেলাইট ব্যবহার শুরু হল এ কাজে।
তবে, এই পদ্ধতিগুলো ছিল স্বল্পমেয়াদি, অর্থাৎ খুব বেশি আগে বোঝার উপায় তাতে ছিল না। হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে, এ রকম কোনও পূর্বাভাসের ব্যবস্থার খোঁজ পড়ছিল তাই। এ ব্যাপারে প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ যিনি করেন, তিনি উইলিয়াম গ্রে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে তিনি ব্যাখ্যা করেন, কেমন ভাবে অনেক আপাত-সম্পর্করহিত বিষয় অনুধাবন করে সাইক্লোনের পূর্বাভাস করা সম্ভব। পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে তাঁর দেখানো পথ মোটামুটি সাফল্য অর্জন করেছিল।
যে পদ্ধতিতে আজকের দিনে সাইক্লোনের গতিপথের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা হয়, তার নাম ‘লার্জ স্কেল সাইনপ্টিক ফ্লো’। সাধারণ ভাবে এর কার্যকারিতা ধরা হয় ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ। কিন্তু আসল মুশকিল গতিপথ নির্ণয়ে নয়, গতি নির্ণয়ে। আগে থেকে গতিপথের কথা বলা যতখানি কঠিন, তার চেয়ে ঢের কঠিন আসন্ন ঝড়ের গতি সম্বন্ধে পূর্বাভাস করা। এ ব্যাপারেও নানা রকম মডেল তৈরি হয়েছে ও নিরন্তর গবেষণা চলছে।
এ সব গবেষণা চলবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক নিখুঁত ভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে। সেটা একটা দিক মাত্র। আর একটা দিকের পরিবর্তন হওয়া খুব দরকার। সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনিই হয়ে যাবে কি না, বলা যায় না। সেটা হল আমাদের আরও বাস্তববাদী হওয়া। বৈজ্ঞানিক উপায়ে লব্ধ ফলাফলের ওপর আরও বেশি আস্থা পোষণ করে সেই মতো কাজ করার মানসিকতা তৈরি করা। এখানেও যথেষ্ট আগে থেকে সতর্কবার্তা ছিল। সেই মতো বাসে করে কর্মীদের আনিয়ে রাখা যেত, সাময়িক থাকার ব্যবস্থা করা কিছু দুরূহ ব্যাপার নয়। তা কিন্তু অনেকেই করলেন না। যাঁরা করলেন— যেমন, যেখানে প্রশাসনের তরফ থেকে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা হল— তাঁরা সাধুবাদের যোগ্য। তাঁরা বহু প্রাণ বাঁচালেন।
আয়লা আর আমপানের মধ্যে ফণী নামক ঝড়টি ঢুকে পড়ে আর এক দফা গোলমাল পাকিয়েছে। যেহেতু অনেক পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও ফণী পশ্চিমবঙ্গে তেমন কিছু ক্ষতি করেনি, তাই আমরা সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলাম যে এ বারেও তাই হবে। যদি মাঝখানে ফণির ঘটনা না ঘটত, আমরা অনেক বেশি ব্যবস্থা নিতাম বলেই আমার ধারণা।
এইখানেই বিজ্ঞানমনস্কতার অভাব। এটা মানতে হবে যে পূর্বাভাসের এই বিজ্ঞান একশো শতাংশ ঠিক হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই, পূর্বাভাস থাকল, ব্যবস্থা নেওয়া হল কিন্তু ঝড় সে ভাবে এল না— এটা হতেই পারে। তার মানে এই নয় পরের পূর্বাভাসে আমরা গা ছেড়ে দেব। ইশপের সেই পালে বাঘ পড়ার গল্প মনে রাখা দরকার। পালে বাঘ হয়তো সব সময় পড়বে না, কিন্তু যে দিন পড়বে, সে দিন প্রস্তুত থাকা চাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy