—ফাইল চিত্র।
এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালে টানটান উত্তেজনার মধ্যে দু’-দু’টি সুপার-ওভার শেষ হওয়ার পরেও দর্শকরা বুঝতে পারছিলেন না, কোন দল জয়ী হল। শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তে জয়-পরাজয় নিষ্পত্তি হল বটে, কিন্তু তাতে বিজয়ী নিরূপণের ‘একুশে আইন’ নিয়ে বিতর্ক থামেনি।
সম্প্রতি এ রাজ্যের বনগাঁ পুরসভার আস্থাভোটকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা দেখা গেল, তা বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের চাইতে কোনও অংশে কম নয়। লাঠি, বোমা, ইটবৃষ্টি— কিছুই বাদ গেল না। আর এত কাণ্ডের পরেও জনসাধারণ বুঝতেই পারলেন না, পুরসভার শাসনক্ষমতা রইল কোন দলের হাতে। কারণ, যুযুধান দু’টি রাজনৈতিক দলই দাবি করছে, তারাই বিজয়ী। আর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, মার খেয়ে নির্বাচনোত্তর প্রতিহিংসার ভীতি উপেক্ষা করে, লাইনে দাঁড়ানো ভোটাররা দেখছেন, জয় যে দলেরই হোক না কেন, তাঁরা বেবাক হেরে বসে আছেন।
তবে এই কুনাট্যের সূত্রপাত কিন্তু সেই ‘দলত্যাগ’ নামক বহু পুরনো ব্যাধি থেকে। প্রকৃতপক্ষে, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অনেকেই এখন রাজনীতিকে পুরোদস্তুর পেশা হিসেবে দেখতে শুরু করেছেন। ফলে তাঁদের কাছে দল, মত, আদর্শ এবং জনমতের কাছে দায়বদ্ধ থাকার চাইতে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতায় টিকে থাকাটা অনেক বেশি জরুরি। ‘রাজনীতি’ শব্দটার মধ্যে ‘নীতি’-কথাটা অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে থাকে, উচ্চারিত হয়, কিন্তু কে না জানে, গোটা দেশের বর্তমান আবহে ‘নীতি’-বিবর্জিত ‘রাজ’-ই সব রাজনৈতিক দলের মোক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে নীতি এবং আদর্শের তোয়াক্কা না করে দেশ জুড়ে এক দলের প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অবলীলায় অন্য রাজনৈতিক শিবিরে যোগদান করছেন।
আমরা দেখেছি, তৃণমূল দল ক্ষমতায় আসবার পর এই রাজ্যেই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত, পুরসভা, এমনকি বিধানসভায় কংগ্রেস, সিপিএম কিংবা তার শরিক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দলে দলে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন এবং এর ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অন্য দলের হাতে থাকা পঞ্চায়েত, পুরসভা, জেলা পরিষদ (অ)গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক দলের দখলে চলে এসেছে।
গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ক্ষমতাবৃদ্ধির পর থেকে এ রাজ্যে বইতে শুরু করেছে উল্টো হাওয়া। তৃণমূলের প্রতীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এ বার বিজেপিতে যোগ দিতে শুরু করেছেন। এর ফলে তৃণমূলের দখলে থাকা বেশ কয়েকটা গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পুরসভা রাতারাতি গেরুয়া শিবিরের দখলে চলে গিয়েছে।
কোনও কোনও ক্ষেত্রে দলত্যাগীরা কিছু দিন পরে পুরনো বাসায় ফিরে এসেছেন বটে, তৃণমূল তাদের হারানো গড়গুলির কয়েকটা পুনর্দখল করতে সমর্থও হয়েছে। কিন্তু এর ফলে সাধারণ মানুষের মনে রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতা-নেত্রী সম্পর্কে যে অশ্রদ্ধা এবং অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে তা রীতিমতো এক অশনি সংকেত।
ভারতবর্ষের সংবিধান রচনাকালে সংবিধান-প্রণেতারা হয়তো পেশাদার রাজনীতিকদের জনসেবা করার এমন মরণপণ প্রবণতার
কথা কল্পনাও করতে পারেননি। ফলে সংবিধানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তাঁর নিজের দলের প্রতি দায়বদ্ধ রাখার তেমন কোনও প্রতিবিধান তাঁরা রেখে যেতে পারেননি।
কিন্তু ভারতীয় গণতন্ত্রের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দলত্যাগের মতো মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপ এত দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করল যে, তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে ১৯৮৫ সালে সংবিধানের সঙ্গে যুক্ত হল দশম তফসিল বা দলত্যাগ-বিরোধী আইন। এই আইনে দলত্যাগ করা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা যদি কমপক্ষে মোট নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এক তৃতীয়াংশ না হয়, তবে তাঁদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাওয়ার সংস্থান রয়েছে। যদিও সদস্যপদ খারিজের আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘প্রিসাইডিং অথরিটি’ কত দিনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, তার কোনও সুস্পষ্ট নির্দেশিকা না থাকায় এক দলের গয়ারাম সদস্য অন্য দলের আয়ারাম হয়ে বহাল তবিয়তে
শুধু থেকেই যাচ্ছেন না, নির্বাচিত সদস্য-ভোগ্য যাবতীয় সুযোগসুবিধার পুরোটাই নিশ্চিন্তে উপভোগ করে চলেছেন।
সার্বিক ভাবে দেশের রাজনীতিতেও একই ছবি বারংবার উঠে আসছে। নির্বাচনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করেও স্রেফ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভাঙিয়ে সরকার গঠন কিংবা সরকার ফেলে দেওয়ার নজির ভূরি ভূরি।
তবে দলত্যাগ-বিরোধী আইনকেও কি মোক্ষম ভাবে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়, সম্প্রতি
তার সবচেয়ে ভাল উদাহরণ দিয়ে গেল কর্নাটক। সদ্যপ্রাক্তন কংগ্রেস-জেডিএস শাসিত কুমারস্বামী
সরকার ভোল পাল্টে হয়ে দাঁড়াল বিজেপি শাসিত ইয়েদুরাপ্পা সরকার।
ঘটনাক্রম বড়ই চমৎকার। কর্নাটক বিধানসভার পনেরো জন কংগ্রেস এবং জনতা দল (সেকুলার) বিধায়ক স্পিকারের কাছে ইস্তফাপত্র জমা দিয়ে সোজা মুম্বইয়ের এক হোটেলে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। জনশ্রুতি, বিজেপির তরফ থেকে তাঁদের এই হোটেলবাসের ব্যবস্থা এতটাই নিশ্ছিদ্র করা হয়েছিল যে, কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ইস্তফা দেওয়া বিধায়কদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে পারেননি। স্পিকার মহোদয় পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে দশ জন বিধায়কের ইস্তফাপত্র খারিজ করে বৈধ ইস্তফাপত্র দেওয়া পাঁচ জন বিধায়ককে আলোচনার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা স্পিকারের সঙ্গে দেখা করেননি। ইস্তফাপত্র খারিজ হয়ে যাওয়া দশ জন বিধায়ক আবার সুবিচার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, এই সব বিধায়ককে কিন্তু ওই তথাকথিত দলত্যাগ-বিরোধী আইনের আওতায় ফেলা গেল না, কারণ দেখা গেল তাঁরা স্বেচ্ছায়(?) নিজেদের সদস্যপদই উৎসর্গ করার জন্যে মরিয়া হয়ে আছেন। এই পরিস্থিতিতে এক সরকার ফেলে আর এক সরকার তৈরি তো নেহাত ছেলেখেলা।
রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘কোনো দোষ পাছে ধরে নিন্দুকে/ নিজে থাকে তারা লোহাসিন্দুকে’। দেশের হালচাল দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ধরে রাখার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে এ বার সত্যি সত্যি ‘লোহাসিন্দুক’-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy