Advertisement
E-Paper

পৈড়ান কালীপুজোর সময়ের অন্যতম লোকক্রীড়া

হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক লোকক্রীড়াই। তবে কয়েকটি খেলা এখনও বজায় রেখেছে রীতি। তেমন এক খেলা পৈড়ান। খেলার উৎপত্তি ও আচার নিয়ে লিখলেন লক্ষীন্দর পালোই পড়িয়া থেকে পৈড়ান শব্দটি এসেছে বলে অনেকের মত। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় পড়িয়া মানে পতিত জমি। সেই জমিতে লোকক্রীড়ার সামগ্রী পোঁতা হয় বলে এমন নাম। আর মাটিতে গেড়ে দেওয়া বা পোঁতা হয় বলে একে পৈড়ানগাড়া বা পৈড়ানপোঁতাও বলা হয়।

পোঁতা হচ্ছে পৈড়ান। নিজস্ব চিত্র

পোঁতা হচ্ছে পৈড়ান। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০২
Share
Save

ওড়িশা এবং সীমানাবর্তী বাংলার এক বিস্তৃত অঞ্চলের লোকক্রীড়ার নাম হল পৈড়ান। এই এলাকাটি একসময়ে ‘বঙ্গোৎকল’ নামে পরিচিত ছিল। ঝাড়গ্রাম জেলার গোপীবল্লভপুর ১ ও ২, সাঁকরাইল, নয়াগ্রাম ব্লক ও নিম্নদাঁতন ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলা, ঝাড়খণ্ডের কিছুটা অংশ ‘বঙ্গোৎকল’এর মধ্যে পড়ত। পৈড়ান শুধু ক্রীড়া নয়, এই খেলায় আছে পরম্পরা, বংশরক্ষা, পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা, সংস্কার-বিশ্বাস, পুত্রসন্তান ও শস্য কামনার আকুতি।

পড়িয়া থেকে পৈড়ান শব্দটি এসেছে বলে অনেকের মত। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় পড়িয়া মানে পতিত জমি। সেই জমিতে লোকক্রীড়ার সামগ্রী পোঁতা হয় বলে এমন নাম। আর মাটিতে গেড়ে দেওয়া বা পোঁতা হয় বলে একে পৈড়ানগাড়া বা পৈড়ানপোঁতাও বলা হয়। খেলার সময়ে হরিধ্বনির মধ্য দিয়ে হক ধরেন। হক মানে অধিকার বা পাওনা। এই অঞ্চলে তা মানত করা বোঝায়। যাঁরা হক ধরেন তাঁরা বংশানুক্রমিক ভাবেই সে কাজ করেন। গ্রামের নির্দিষ্ট কয়েকজন হক ধরা তথা মানতকারী বা যথার্থকারী থাকেন। পিতার পরে পুত্র হক ধরে থাকেন। যেমন বেলিয়াবাড়া এলাকার কালিঞ্জা গ্রামের ঝন্টু দণ্ডপাট। তিনি বললেন, ‘‘আগে আমার বাবা হক ধরতেন। এখন আমি ধরি।’’ কালিশঙ্কর দণ্ডপাটেরও একই কথা।’’ পাশাপাশি পৈড়ানকে কেন্দ্র করে পুরুষদের মধ্যে বাগড়িখেলা, মল্লযুদ্ধ ও লাঠিখেলার আয়োজন করা হয়। সেসব বড় নৈপুণ্যের খেলা। একই সঙ্গে সেসব ক্রীড়াচর্চা এবং ঐতিহ্য পালন।

কী ভাবে পৈড়ান তৈরি হয়? বেলিয়াবাড়ার কালিঞ্জা গ্রামের গৌর পাত্র জানালেন, শক্ত কাঙ্গুরা (পাটের মতো এক ধরনের গাছ) পাকিয়ে পাকিয়ে মোটা মোড়া বা ব্যাঠনা বা দড়ি তৈরি করা হয়। তার পর তা রাস্তার মাঝে একবেঁয়ু (দু’হাত বা ৬ ফুট বোঝায়)। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় ডাঁয়া বা বেঁয়ুর অর্থ হাত। সোজা ও আড়াআড়ি একবেঁয়ু গর্ত করে লোহার শাবল দিয়ে কাঙ্গুরার মোড়াটি ঘরাগিঁট দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে খুলে না যায় বা ছিঁড়ে না যায়। ঘরাগিঁট একধরনের বাঁধার পদ্ধতি। অনেকে এর সঙ্গে সাতচাড়া বা সাত পিট্টুখেলার মিল খুজে পান। আবার পৈড়ান খোঁড়ার পদ্ধতির সঙ্গে নিজের জমির সীমা সম্পর্কিত সচেতনতা খুঁজে পাওয়া যায়। পৈড়ান খোঁড়ার পর ভাল করে খোঁড়া মাটিগুলো বিছিয়ে দেওয়া হয়। তার পর জায়গাটি গোবরজল দিয়ে নিকানো হয়। এর পর আতপচাল বাটা, মেথি ও হলুদ দিয়ে গঁধুলা তৈরি করে মাটির উপরে দিয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হয়। এর পর আতপচাল, হরিতকি, দূর্বাঘাস, সিঁদুর, ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। প্রসাদ দেওয়া হয় চিড়ে ও গুড়। পয়াপিণ্ড বা গুড়পিঠে বা আসকা পিঠেও খাওয়ানো হয়। কার্তিক মাসের ভূত অমাবস্যার দিনে কাকভোরে পৈড়ান গাড়তে হয়। যাতে কেউ দেখতে না পান।

কার্তিক মাসে ভূত অমাবস্যার দিনে কেন পৈড়ানগাড়া হয়? পূর্ণচন্দ্রদাস তাঁর ‘কাঁথির লোকাচার’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, এটি লোকবিশ্বাস। পিতৃপুরুষকে আলো দেখানো হয় এই দিনে। শ্যামাপুজোর পরের দিন করা হয় ‘দর্পণদর্শন’। এই ‘দর্পণদর্শন’ই ‘বঙ্গোৎকলে’ পৈড়ান। পৈড়ানকে আবার প্রতিপদের ফোঁটা বলা হয়। কারণ এর পর দ্বিতীয়ায় হল যমদ্বিতীয়া বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। কাকভোরে তেল, হলুদ ও ঘি মেখে কপালে ‘রক্ষাটিপ’ পরে কলাপাতা ও বিরি-কলাই দিয়ে তৈরি ‘পড়াপিঠে’ খেয়ে বেরতে হয়। গরুকে তেল ও সিঁদুর দেওয়ার নিয়ম আছে। যাকে ‘গোপাষ্ঠমী’ বলা হয়। গরুকে নদীতে জল খাওয়া তে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বলা হয়, ‘পাঁইপোল’। ‘পাঁই’ হল জল, ‘পোল’ হল পান করা। বলা হয়, ‘পড়িয়ায় ঘাস নাই/বাগায়ের দোষ নাই/পাঁই পোল পোল’।

কার্তিক মাসের ভূতঅমাবস্যার রাতে অলক্ষ্মী বিদায়ের জন্য দিনের বেলা আখ কেটে রাখা হয়। ভাঙাকুলো, ভাঙাডালা, ভাঙাঝুড়ি ভাঙাটিন প্রভৃতি জোগাড় করে রাখা হয়। আখ গাছ রাতে বাড়ি বাড়ি পুঁতে দিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া রাত্রে কাঙ্গুরা কাঠি জ্বালিয়ে পুকুরে ভাসিয়ে দিয়ে অলক্ষ্মী পুজো বা ভূতপুজো করা হয়। এর পর গোয়ালঘর, ঘরের বিভিন্ন কোণ থেকে আখ দিয়ে ভাঙা টিন ভাঙা ডালা, ভাঙাঝুড়ি ভাঙাকুলো বাজিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে কেটে মশা মাছি পোকামাকড়, অপদেবতা, ভূত, পেত্নী তাড়ানো হয়। যেমন, ‘যারে মশা যা বুড়ার উইতলে যা/উইতলে ছিঁড়া কাপড় রক্তচুষি খা/যারে মশা যা’। কাকভোরে গ্রামের মাথায় ভাঙাকুলো, ডালা, ঝুড়ি, আখ ফেলে দিয়ে আসা হয়। সুধীর করণ তাঁর ‘সীমান্ত বাংলার লোকযান’ গ্রন্থে অলক্ষ্মী বিদায় এবং পুরুলিয়ার ‘ইঁজে-পিঁজে’ অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। লোকবিশ্বাস, অর্ধদগ্ধ কাঙ্গুরাকাঠি নিয়ে এসে বাস্তুতে পুঁতে রাখলে অশুভশক্তি ঘরে কু-নজর দিতে পারে না। খোস-পাঁচড়া চর্মরোগ না হয়। পূর্ণচন্দ্র দাসের ‘কাঁথির লোকাচার’ গ্রন্থে অলক্ষ্মী বিদায়ের গানের কথা আছে, ‘লক্ষ্মী আইলা অলক্ষ্মী পলা’। অমলেন্দু মিত্র তাঁর ‘রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর’ গ্রন্থে বলেছেন, অলক্ষ্মী বিদায়ের পর থেকে নববর্ষ পালন করা হয়। অলক্ষ্মী বিদায় করে জমি থেকে ধানের শিষ নিয়ে আসা হয়। তাঁর মতে, দীপান্বিতা আদিবাসীদের আদিম বিশ্বাস। ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ে উচ্চবর্ণেরও পালনীয় হয়েছে।

পৈড়ানের নানা আচার রয়েছে। পুত্র কামনায় পৈড়ানের দিনে হক ধরা হয়, ‘হো হো/বয়ার নাই বাতাস নাই/উড়ি আয়লা খাসি/অমুক লোকের (যাঁর নামে মানত) পো হিনে/মিঠেই খাবো বসি বসি/হো হো’। পৈড়ানগাড়ার মধ্যে দিয়ে পুরুষের সক্ষমতা পরখ করা হত। আয়োজন হত বাগড়ি বা বাড়ি টানাটানি খেলার। ঢাক বাজত আর চলত বাড়ি টানা। মোটা লাঠি বা বাড়ি নিয়ে মাটিতে বসে দু’টো পা মেলে দিয়ে পরস্পর পরস্পর পায়ের পাতা শক্ত করে চাপ দিয়ে লাঠি নিয়ে কে কাকে তুলতে পারে তার পরীক্ষা চলত। বিকেলে পৈড়ানতোলা হত। হরিধ্বনি দিয়ে ‘হো হো’ রব তুলে পৈড়ানের ফাঁদে তাড়া বা শক্ত মোটা শালগাছের গুঁড়ি দিয়ে কাঁধে নিয়ে পৈড়ান তোলা হত। তার পর চিড়ে-গুড় খেয়ে পৈড়ান খেলা শেষ হত।

শ্যামাপুজোর পরের দিন গ্রামে যাঁদের বাড়িতে আখ গাছ পোঁতা আছে তাঁদের বাড়িতে হক ধরা হয়। অনেকে পৈড়ানকে ইক্ষু সংস্কৃতি বলছেন। যে অঞ্চলে পৈড়ান গাড়তে দেখা যায় সেই অঞ্চলে প্রচুর আখ চাষ হয়। রগড়া রোহিণী, কুলবনী, কাঁটাপাল, কালিঞ্জা, ভক্তাপাঠ প্রভৃতি অঞ্চলে এক সময় প্রচুর আখ চাষ হত। রগড়ার গুড় ছিল বিখ্যাত। এই অঞ্চল এক সময় পৌন্ড্রদের শাসনাধীন ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে হিউয়েন সাঙ পুন্ড্র ও কলিঙ্গ দু’টি পৃথক জনপদের কথা বলেছেন। পুরো ঝাড়গ্রাম জেলা এক সময় পুন্ড্র জনপদের অন্তর্গত ছিল। ইক্ষুর আর এক নাম পৌন্ড্র। আখ খেতে পন্ডাসুর নামে এক অপদেবতা কথা জানা যায়। পৈড়ান গানে বা হক ধরতে শোনা যায়, ‘হো হো/ক্ষেত্রপালের ভাণ্ডার হউ/ঘর ঘর গুড়কুঁদা হউ/হো হো’। আবার হক দেওয়া হয়, ‘কুবেরের ভাণ্ডার হউ/রাজার দুয়ারে যম পাউ/হো হো’। বা ‘যার যত রোগ-ব্যাধি আছে/সব যেন দূর হয়/হো হো’।

কালের প্রবাহে অনেক লোক খেলাই জঙ্গলমহল থেকে হারিয়ে গিয়েছে। ছেলকা, সীতাহরণ, দাড়িয়া, পঞ্চাশচোর, নামপাতাপাতি, তিরকঁড় ইত্যাদি। পৈড়ান এখনও ধারাবাহিক।

লেখক অধ্যাপক ও লোকসংস্কৃতির গবেষক

West Bengal Odisha Poiran Traditional Game

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}