বাঙালির সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক ইতিহাসে নবনীতা দেব সেন কোনও বিচ্ছিন্ন, একক ধারাপাত নন। তাঁর ঐতিহ্যে কবিদম্পতি নরেন্দ্র দেব ও রাধারাণী দেবী নিত্য বহমান।
রাধারাণী, না কি অপরাজিতা? এই মহিলার কবিতা রবীন্দ্রনাথকেও চমকে দিয়েছিল। আজ সকলে জানে, অপরাজিতা ছিল রাধারাণী দেবীর ছদ্মনাম। তিনি বিধবা, পরে আর এক কবি নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিয়ে হয়। নরেন্দ্র ওমর খৈয়াম এবং আরও অনেকের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্রের ইতিহাস লিখেছিলেন।
এ দিকে, বালবিধবা রাধারাণীকে তাঁর সেই প্রথম শাশুড়ি মেয়ের মতোই ভালবাসতেন। নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে বিয়ে, নবনীতার জন্ম, বেড়ে ওঠা... স্নেহের ধারায় ব্যত্যয় ঘটেনি। সংসার বদলালে ভালবাসা মরতে যাবে কোন দুঃখে?
ভালবাসার এই সহজ সারল্য থেকে আজীবন সরে আসেননি নবনীতা। ছোট্ট উদাহরণ। ১৯৯৮ সাল। গাদিয়াড়াতে পিকনিকে গিয়েছেন, টেলিভিশনে আচমকা অমর্ত্য সেনের ছবি। নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত, ‘তা হলে এ বার নিশ্চয় পেয়ে গিয়েছেন।’ অমর্ত্য নোবেল পাবেন, স্বাভাবিক! এবং তিনি তা জেনে শিশুর মতো আহ্লাদিত হয়ে উঠবেন, এটাও সমান স্বাভাবিক। পারিবারিক দলাদলিতে ঘোঁট পাকানো বাঙালির কাছে এ সব অস্বাভাবিক লাগে, সেটাও স্বাভাবিক!
এই সহজিয়া স্বাভাবিকত্বকে না বুঝলে নবনীতার জীবন ও সাহিত্যকে প্রতি পদে অস্বাভাবিক ঠেকবে। যিনি দেশ ও বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের সম্মাননীয় অধ্যাপক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রাধাকৃষ্ণন স্মারক বক্তৃতা দেন, তিনিই কি সরস বাংলা গদ্যে নিজেকে নিয়ে হাসির ফুলঝুরি ছড়াতেন? নরেন্দ্র ও রাধারাণী দু’জনেই ছিলেন প্রতিভাবান, আমুদে ও আড্ডাবাজ। রাধারাণী দেবীকে তো শরৎচন্দ্র তাঁর ‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসটি শেষ করার দায়িত্ব দিচ্ছিলেন। অন্য দিকে নরেন্দ্র দেব তখন রবীন্দ্রোত্তর ‘ভারতী’ পত্রিকার অন্যতম স্তম্ভ। লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পিইএন’-এর অন্যতম ভারতীয় কর্তা। আন্তর্জাতিক স্তরে লেখকদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র ও রাধারাণী দেবী তখন নিত্য আমন্ত্রিত। তাঁদের একমাত্র ছোট্ট ‘খুকু’কে নিয়ে তাঁরাও সেখানে যান। নবনীতা দেব সেন পরে কেন ফুসফুসে হাঁপানি রোগ এবং পায়ের তলায় সরষে নিয়ে কখনও আলাস্কা, কখনও বা আফ্রিকার জঙ্গলে চলে যান, সেই রহস্য তাঁর পারিবারিক ‘ভালোবাসা’য় নিহিত।
এই ভালবাসা ছিল বলেই তাঁর ভ্রমণকাহিনি কখনও নিছক অ্যাডভেঞ্চার হয়ে ওঠেনি। কেদারনাথে গিয়ে গাড়িবিভ্রাট, ঘোড়াওয়ালা অনেক কিছু। তবু তার পরও মনে হয় ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’! বাংলা ভ্রমণসাহিত্যে তিনি সৈয়দ মুজতবা আলির বৈঠকি মেজাজ বা উমাপ্রসাদীয় মুগ্ধতার বাইরে বিরল ব্যতিক্রম। তাঁর বেড়ানো অনেকটা অবুঝ বাচ্চা মেয়ের মতো। ভ্রমণসংক্রান্ত শেষ ও পঞ্চদশ বইয়ের নামেই মালুম, ‘যাবোই যাবো পেরু’।
পঞ্চাশের দশকে স্কুলজীবনের শেষে এই পারিবারিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা এক মেধাবী কন্যের গন্তব্য থাকে একটিই। প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি পড়া। সে তিনি নবনীতা বা সত্যজিৎ রায়ের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির নায়িকা যা-ই হন না কেন! নবনীতাকে অবশ্য তাঁর পারিবারিক আত্মীয়েরা একটি শর্ত দিয়েছিলেন। কো-এড কলেজে পড়লেও কফি হাউসে গিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে না।
বি এ পাশ করার পর খুলে গেল আড্ডার অন্য ভুবন। কলেজ স্ট্রিট থেকে যাদবপুরে এসে বুদ্ধদেব বসুর হাতে গড়া তুলনামূলক সাহিত্যে এম এ পড়তে এলেন। বাড়িতে বাবা নরেন্দ্র দেবের সান্নিধ্যে জানা ছিল হাফিজ, ওমর খৈয়াম। মাস্টারমশাই বুদ্ধদেব চেনালেন বদলেয়ার, রিলকে ও মালার্মেকে। দুই ধারার স্রোত এসে মেলার পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ১৯৫৮ সালে এম এ পরীক্ষায় শুধু তুলনামূলক সাহিত্য নয়, মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারীর স্বর্ণপদক। পরের বছরই তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়’।
এই প্রত্যয় তাঁর জীবনের সর্বত্র। ষাটের দশকে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনীতা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ফেলো। তাঁর বড় মেয়ে সবে জন্মেছে। ক্যাম্পাসে পুলিশ, মুক্ত চিন্তার পরিসর ক্ষুণ্ণ হওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ। প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে তারা, গান গাইতে গাইতে চলেছেন জোন বায়েজ। নতুন বাঙালি মা-ও সেই আন্দোলনে। এর মধ্যে বড় কিছু খোঁজার চেষ্টা অস্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী পরিসর ক্ষুণ্ণ হলে তা নিয়ে প্রতিবাদই তো প্রথম স্বাভাবিকতা!
দেশে ফিরে সব্যসাচীর মতো দু’হাতে গল্প, উপন্যাস ও রম্য রচনা। রোজকার অধ্যাপনা। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু হিন্দুস্থান পার্কের সেই ভালোবাসা বাড়ি? তিন তলায় মা রাধারাণী দেবী, দোতলায় নবনীতা ও তাঁর দুই মেয়ে। এই বাড়ি ও তার পরিবেশ নিয়ে নবনীতা অনেক সরস গল্প লিখেছেন। রাস্কিন বন্ডের লেখায় যেমন তাঁর নিজের শহর ল্যান্ডোর বারংবার ঘুরেফিরে আসে, নবনীতার ক্ষেত্রেও সে রকম। শেষ দিকে তাঁর এক সাপ্তাহিক কলমের নামই ছিল ‘ভালো-বাসার বারান্দা’।
তাঁর ভালবাসা জন্ম, মৃত্যু ও জীবনকে ঘিরে। নবনীতা যখন তাঁর প্রয়াত বন্ধু যশোধরা বাগচী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, সুবীর রায়চৌধুরী বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন, তখনও বিয়োগব্যথা প্রাধান্য পায়নি। বিষাদের রেশ গিয়ে মিশেছে অনন্ত জীবনরঙ্গে। বাঙালি লেখিকাদের নিয়ে ‘সই’ নামে একটি সংগঠন করেছিলেন, সেই সংগঠনের প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছিল তাঁর এক নাটক ‘অভিজ্ঞান দুষ্মন্তম্’। যে রাজা বালিকা প্রণয়িনীকে ছেড়ে যান, তার অন্য পিঠ।
আসলে রঙ্গকৌতুক বাদ দিয়ে তিনি যে থাকতে পারবেন না, ১৯৮৪ সালে বেরোনো তাঁর প্রথম রম্য রচনার বইয়ের নামই তার প্রমাণ। ‘নটী নবনীতা’। রঙ্গকৌতুক আর রম্যরচনার লেখক যে জানতেন রাজা লিয়রের সেই অমোঘ কথা, ‘অল দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ় আ মিয়র স্টেজ।’ এই জীবনমঞ্চে কখনও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে তাত্ত্বিক সন্দর্ভ রচনা করতে হয়, কখনও নিজের ভাষায়, নিজের জীবন নিয়ে রঙ্গ। কোন চরিত্র আসল, সে কি অভিনেতা নিজেই জানেন?
এই আসল-নকল নিয়ে ভাবেননি বলে নবনীতা বারংবার ছুটে ছুটে গিয়েছেন বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। কখনও সমকামী বিয়ে নিয়ে ‘বামাবোধিনী’র মতো উপন্যাস, কখনও বা ‘শীত সাহসিক হেমন্তলোক’। কখনও তুলে আনছেন চন্দ্রাবতী রামায়ণ, কখনও বা কর্নাটকের বীরশৈব কবিতা।
বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে ছুটে যাওয়া এই সরস লেখককে কর্কটরোগ থামিয়ে দিতে পারে না, শস্ত্র ছিন্ন করতে পারে না, অগ্নি দাহ করতে পারে না। বাংলা সাহিত্যের আগামী ইতিহাসেও ‘নটী নবনীতা’ তাই মনকাড়া এক বিস্ময়চিহ্ন হয়েই থেকে যাবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy