প্রতীকী ছবি।
গোটা বিশ্ব আজ করোনা-আতঙ্কে ত্রস্ত। অপ্রতিরোধ্য সংক্রমণের গতি নিয়ে বিশ্বের দু’শোর বেশি দেশের আটাশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে এই মারণ ভাইরাস। আট লক্ষের বেশি মানুষ করোনার থাবা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও এখনও পর্যন্ত প্রায় দু’লক্ষ মানুষের দুঃখজনক মৃত্যুর সাক্ষী থেকেছে পৃথিবী। মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলিকে কার্যত অসহায় করে করোনা রূপ নিয়েছে বিশ্বব্যাপী মহামারি বা ‘প্যানডেমিক’-এর।
তবে শুধু করোনা নয়, বিশ্ব-ইতিহাসে এমন বহু মহামারির লিখিত উল্লেখ মেলে, যেগুলি খুব দ্রুত কোনও জনগোষ্ঠী বা দেশ থেকে দেশান্তরে প্রবল আকার ধারণ করেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানির কারণ হয়েছে। তবে সব চেয়ে বেশি বার যে রোগের কারণে মহামারি দেখেছে গোটা বিশ্ব, তা হল প্লেগ।
পৃথিবীর প্রথম প্লেগজনিত মহামারির উল্লেখ মেলে আনুমানিক ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইডসের ‘হিস্ট্রি অফ দ্য পেলোপনেসিয়ান ওয়ার’ থেকে জানা যায়, এথেন্সে গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়। তিরিশ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। এথেন্সই ছিল রোগের উৎসভূমি। তবে এই মহামারির কারণ প্লেগ কি না, তা নিয়ে মতান্তর আছে।
৫৪০-৪১ খ্রিস্টাব্দে মিশরে এমনই এক ভয়ঙ্কর প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। সে সময়ে রোমে রাজত্ব করছেন শক্তিশালী সম্রাট জাস্টিনিয়ান। বাইজান্টাইনের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে এই রোগের সূত্রপাত হলেও পরে তা গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। রোগ ছড়ানোর মূলে ছিল ইঁদুর। রোগের প্রভাব এত বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল যে, এই সময়টা ইতিহাসে ‘ডার্ক এজ’ নামে পরিচিতি পায়। ইতিহাসবিদদের মতে, এমনও সময় গিয়েছে যখন প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে এই রোগে। সব মিলিয়ে প্রায় কয়েক কোটি মানুষের প্রাণ যায়। ১৩৩৪ সালে এমনই আর এক প্লেগ চিন থেকে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। মাত্র ছ’মাসে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে প্রায় নব্বই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সে সময়ে।
ইতিহাসে ‘কালো মৃত্যু’ বা ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত আর এক প্লেগ মহামারিজনিত বিপর্যয়। কৃষ্ণসাগরের (ব্ল্যাক সি) উপকূলবর্তী অঞ্চল থেকে এই রোগের উৎপত্তি বলেই এমন নামকরণ। সময়কাল, ১৩৪৬ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ। সে সময়ে কৃষ্ণসাগর ছিল ইউরোপ ও এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম। পরে তা ‘সিল্ক রোড’ হয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছয়। প্লেগের জীবাণুবাহী ইঁদুর ও মাছি বিভিন্ন জাহাজের মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে দিয়েছিল একাধিক মহাদেশে। এটিও দীর্ঘস্থায়ী একটি মহামারি ছিল। প্রজন্মের পর প্রজন্মকে সেই ক্ষত বহন করতে হয়েছিল। ইউরোপের মোট জনসংখ্যার ৩০-৬০ ভাগ মানুষ মারা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির কবজি বা বগলে টিউমারের মতো বেশ বড় ফোঁড়া হত। তার পরে সারা শরীরে ছেয়ে যেত ফোঁড়া। এক সময়ে সেগুলি পচে গিয়ে পুঁজ বেরোত এবং সাত দিনের মধ্যেই আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হত।
প্লেগের মতোই অপর একটি ভয়ঙ্কর মহামারির জন্ম দিয়েছিল ‘স্মল পক্স’। ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মেক্সিকোতে এই মহামারির কারণে দু’বছরে প্রায় আশি লক্ষ মানুষ মারা যায়। ১৬৩৩ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে রোগটি ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় দু’কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এর পরে আমেরিকারই ফিলাডেলফিয়ায় ১৭৯৩ সালে ‘ইয়োলো ফিভার’ মহামারির আকার নেয়। তাতে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা যায়। আঠারো শতকের শেষ ভাগে পক্সের টিকা আবিষ্কার হলেও এর দু’শো বছর পরেও ভারতে এই রোগ মহামারির আকার নিয়েছিল। ১৯৭০ সালে ভারতে এই রোগে প্রায় লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়। অবশ্য বছর পাঁচেকের মধ্যেই রোগ
নিয়ন্ত্রণে আসে।
প্লেগের তৃতীয় ভয়াবহ রূপ দেখা যায় ১৮৬০ সালে। উৎপত্তিস্থল, চিনের য়ুহান নামের গ্রাম। সেখান থেকে দেশের প্রধান শহরগুলির মধ্যে দিয়ে তা বেশ কয়েকটি দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দু’দশক তা স্থায়ী হয়। পরে ১৮৯০-এ প্লেগের টিকা আবিষ্কার হওয়ার পরে এর প্রকোপ কমতে থাকে। তবে তার আগেই প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। টিকা আবিষ্কার হলেও ১৯১০ সাল নাগাদ চিনেরই মাঞ্চুরিয়ায় আবার প্লেগ মহামারি আকার নেয়। দু’বছরে প্রায় ষাট হাজার মানুষ মারা যায়।
প্লেগ ও স্মল পক্সের মতো আর একটি রোগ মহামারির আকার নেয় ১৯১৬-তে। রোগটি, পোলিও। চিকিৎসায় ক্রমোন্নতি ঘটলেও কার্যত এর প্রকোপে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়। বিপর্যয়ের শিকার ছিল আমেরিকাও। নিউইয়র্কে ন’হাজার পোলিও আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ছ’হাজারের মৃত্যু হয়। এখনও কত মানুষ পোলিও আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, সারা বিশ্বে তার ঠিক কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। বিশ শতকের মাঝামাঝি পোলিও-র টিকা আবিষ্কার হওয়ার পরে অনেক দেশই পোলিওমুক্ত হতে পেরেছে।
বিশ শতকের প্রথম ভাগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মারা যায় প্রায় দু’কোটি মানুষ। চার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও বিস্ময়কর বোধ হয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ঠিক পরেই ইনফ্লুয়েঞ্জায় মাত্র এক বছরেই মারা যাওয়া প্রায় এক কোটি মানুষের সংখ্যাটা। বর্তমানে করোনার প্রকোপে যে ভাবে দেশে ‘লকডাউন’ চলছে, সে সময়েও রোগ ঠেকাতে জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।‘ মাস্ক’ পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৯১৯-এ এই রোগ বিশ্বব্যাপী মহামারির আকার নেয়। বিশ শতকের দান আরও একটি রোগ, যা এখনও অপ্রতিরোধ্য, তা হল এডস। ১৯৮৪-তে আমেরিকায় প্রায় ছ’হাজার মানুষ এডসে মারা যায়। বর্তমানে গোটা বিশ্বে এডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ। মারা গিয়েছে কয়েক কোটি।
একবিংশ শতকের শুরুতেও নতুন একটি মারণ রোগ চিকিৎসকদের ঘুম উড়িয়েছিল, যার পোশাকি নাম ‘সার্স’। প্রতিকারের উপায় হিসেবে ‘মাস্ক’ ব্যবহারের পাশাপাশি জমায়েত নিষিদ্ধকরণ হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ায় রোগটি ছড়িয়ে পড়ে ২০০৩ সালে। তবে ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের কারণে এই রোগে খুব বেশি মানুষ মারা যায়নি। এর পরে একে একে সোয়াইন ফ্লু, কলেরা, হাম, ইবোলা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে দাপট দেখিয়েছে। ২০১৪-তে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা জ্বরে প্রায় বারো হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
তবে শুধু মৃত্যু নয়, মহামারির সুদূরপ্রসারী প্রভাবে গোটা ভূখণ্ডের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক চিত্রটাও আমূল পরিবর্তিত হয়। করোনাভাইরাসের প্রভাবেও যেমন গোটা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক চেহারায় একটি বড়সড় বদলের সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই।
(তথ্যসূত্র: ডিজিজ় অ্যান্ড হিস্ট্রি, ফ্রেডরিক এফ কার্টরাইট)
লেখক বাঁকুড়ার সিমলাপালের স্কুলশিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy