হাতির পাল। ফাইল চিত্র
১৯৭৫ সালে অভয়ারণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছিল দলমার জঙ্গল। অভয়ারণ্য ঘোষণা করার পিছনে উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট ছিল। উদ্দেশ্য ছিল ছোটনাগপুর মালভূমির এই ঋদ্ধ অঞ্চল এবং তার গাছপালা, তার বন্যপ্রাণকে নির্ভয়ে সেখানে বসবাসের করতে দেওয়া। কিন্তু বেশি দিন সেই অবস্থা বহাল থাকল না। তাদের শান্তি বিঘ্নিত হল। চলাচলের ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হল। যার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়তে শুরু করল ঝাড়খণ্ড তো বটেই, সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলায়।
সমস্যার সূত্রপাত ১৯৮৭ সালে। ঝাড়খণ্ডের ‘স্টিল সিটি’ জামশেদপুর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে, পশ্চিমে জমজমাট চান্ডেল শহর, সেই শহর ঘেঁষে দলমা রেঞ্জের সমান্তরালে চলে গেল জাতীয়সড়ক। বসানো হল রেললাইন। দুইয়ের জোড়া প্রভাবে রাঁচী সংলগ্ন ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে গতায়াত সমস্যা হয়ে দাঁড়াল দলমার হাতিদের কাছে। এর সঙ্গে শুরু হল আরেকটি বিষয়। সুবর্ণরেখা নদীর বহুমুখী প্রকল্পের জেরে বলি হয়ে গেল দলমার জঙ্গলের বিস্তীর্ণ এলাকা।
এ দিকে দলমার পূর্ব দিকে বিগত ১০০ বছর ধরে শাল-পলাশের জঙ্গল সাফ করে নিজেদের মতো বসবাস করছে মানুষ। তাঁরা দরিদ্র। জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক ভাবে তো বটেই, সাংস্কৃতিক ভাবেও। পশ্চিমে গতায়াতের সুযোগ না পেয়ে দলমার হাতিরা এই পূর্বেরই বিভিন্ন এলাকা ‘আবিষ্কার‘ করতে শুরু করল।
এর কারণও ছিল। দলমার পূর্ব ভাগে জঙ্গল তখনও অবশিষ্ট ছিল। তার উপরে পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ তৈরি করেছিল কিছু সবুজ দ্বীপ। সেই সবুজ দ্বীপে খাদ্যন্বেষণে এবং ভাগ্যান্বেষণে বছরের অগস্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ পাড়ি দিতে থাকল দলমার দামালেরা। প্রথম প্রথম এতে আনন্দই পেয়েছিলেন বনাঞ্চল সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলির মানুষ। কিন্তু খুব স্বাভাবিক সীমান্তবর্তী বনাঞ্চল এতটাও গহিন বা ঋদ্ধ ছিল না যাতে দলমার হাতিদের খাদ্যের প্রয়োজন মেটে। অতঃপর পাকা ধানের গন্ধে তারা আকৃষ্ট হতে থাকে জঙ্গল সংলগ্ন ধানখেতের দিকে। দিনরাতের মেহনত এক করে ফলানো খেতের ফসল নষ্ট হতে দেখে হাতির উপর ক্ষুব্ধ হতে শুরু করে গ্রামের মানুষ।
তবে এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় মানুষ-বন্যপ্রাণ ‘কনফ্লিক্ট’ নয়। বিষয়, কেন বছরের পর বছর দলমার পরিযায়ী হাতিদের মধ্যে দলমায় ফিরে যাওয়া নিয়ে তীব্র অনীহা দেখা দেয়? এই অনীহার কারণ কী? বন দফতরের হিসাব বলছে, পুরুলিয়া জেলার অন্যান্য এলাকাগুলিতে হাতির উপদ্রব মোটামুটি থাকলেও একেবারে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ঝালদা, বাঘমুণ্ডি, মাঠা, কোটশিলা, বান্দোয়ান কিংবা বলরামপুরের মতো রেঞ্জগুলিতে বছরের বিভিন্ন সময় বুনোহাতিদের আতঙ্কে লোকজনকে ভয়ে কার্যত সিঁটিয়ে থাকতে হয় ঘরে। বলা যেতে পারে, এই রেঞ্জগুলিতে হাতির হানায় ক্ষয়ক্ষতির ‘গ্রাফ’ সবসময় ঊর্ধ্বমুখী। দফতরের হিসাবই বলে দিচ্ছে, এই রেঞ্জ এলাকাগুলির মধ্যে একবার নয় অনেকবার হাতির সামনে পড়ে গিয়ে প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটে গিয়েছে।
কিন্তু বর্তমানে অন্য একটা বিষয় রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে জঙ্গল এলাকার বাসিন্দাদের। কপালে ভাঁজ পড়েছে বন দফতরেরও। কয়েকবছর থেকে দেখা যাচ্ছে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল থেকে সীমানা অতিক্রম করে এ রাজ্যে ঢুকে পড়া হাতিদের অধিকাংশই আর ঝাড়খণ্ডে ফিরতে চাইছে না। মাসের পর মাস এ রাজ্যের জঙ্গলে থেকে তারা রেসিডেন্ট হাতির মতো আচরণ শুরু করে দিচ্ছে। এমন কি, জঙ্গল থেকে বনকর্মীদের তাড়া খেয়ে পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খণ্ড সীমানা পর্যন্ত গিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে আগের আশ্রয়েই ফিরে এসেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, কিছু দিন আগে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা বুনো হাতিদের একটা দল এখনও ঝালদার খামারের জঙ্গলে রয়ে গিয়েছে। সেই জঙ্গলে সম্প্রতি একটা শাবকের জন্ম দিয়েছেন ওই দলে থাকা এক হস্তিনি। ওই শাবকের কথা ভেবে আপাতত ‘ড্রাইভ’ (হাতি তাড়ানো) বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে ওই শাবকের জন্মের আগে দলটিকে যতবার ঝাড়খণ্ডের পথ ধরানোর চেষ্টা করা হয়েছে, প্রতিবারই সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝালদা রেঞ্জের কর্মীরা।
তা হলে কোথাও কি বুনো হাতিরা তাদের চরিত্র বদলাচ্ছে? যাঁরা এ জেলায় দীর্ঘদিন ধরে দফতরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন, তাঁদের কয়েকজনের মতে, গত কয়েক দশকে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলগুলিতে গাছের ঘনত্ব কমে এসেছে অনেকটাই। তাঁদের দাবি, পরিকল্পনা করে বৃক্ষরোপণ না হওয়ার পাশাপাশি রাতের অন্ধকারে জঙ্গলগুলিতে কাঠ-মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে ঘন জঙ্গলগুলি হারিয়েছে তার নিজস্বতা। জঙ্গলের ঘনত্ব কমে যাওয়ায় সেখানে পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে হাতিরাও সেই জঙ্গলকে আর নিরাপদ মনে না করে বেরিয়ে পড়ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। এ রাজ্যে ইদানীং জঙ্গলের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তারা সেই জঙ্গলের মোহ ছাড়তে পারছে না। এই জঙ্গলকেই নিজেদের ঘর মনে করে তাই আর ফিরতেও চাইছে না ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে।
তবে শুধু এখানেই শেষ নয়। হস্তিবাহিনীর এই বঙ্গপ্রীতির আরও একটা বড় কারণ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ মহলের একাংশের অভিযোগ, কিছুদিন আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাতি তাড়ানোর ক্ষেত্রে আগুনের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করলেও এখনও ঝাড়খণ্ডের মতো আরও কয়েকটি রাজ্যে হাতিকে এলাকা ছাড়া করতে সেই রাজ্যের হুলার লোকজন চুপিসারে আগুনের ব্যবহার করেন। এমন কি, হাতির দল যেন এলাকায় আর ফিরে না আসে সেই বিষয়টিকে সামনে রেখে কোথাও কোথাও হাতির দলের দিকে আগুনের গোলা পর্যন্ত ছুঁড়ে মারা হয়। তা ছাড়া, হাতির গায়ে পটকা ছুঁড়ে মারার পাশাপাশি কাপড়ের বল বানিয়ে সেই বলকে পোড়া মোবিলে চুবিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে হাতির গায়ে ছুঁড়ে মারার মতো অভিযোগও প্রায় সময় শুনতে পাওয়া যায় পরিবেশকর্মীদের কাছ থেকে। তাঁদের এক জনের কথায়, এখনও কিছু কিছু রাজ্যে হাতি তাড়ানোর ক্ষেত্রে হুলার লোকজনেরা লোহার ধারাল ফলা গনগনে আঁচে গরম করে তা হাতির গায়ে ফুটিয়ে এলাকাছাড়া করার চেষ্টা করে। এখানে এই কুঅভ্যাস তুলনামূলক কম হওয়ায় এখানকার জঙ্গলকেই নিরাপদ মনে করছে হাতিরা।
সমস্যা গুরুতর তথা উভমুখী। দুই প্রজাতি টিকে থাকার অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এক দলের শক্তি বেশি। অন্য দলের বুদ্ধি। কিন্তু মানুষ তো ইতিমধ্যেই পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র নিজের উপস্থিতি সগর্বে ঘোষণা করেছে। করেছে এমন জায়গাতেও, যেখানে তার উপস্থিতির বিন্দুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। যেমন হয়েছে দলমার রেঞ্জের ক্ষেত্রে। বর্তমানে পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণ করে হাতির কাছে যদি জঙ্গলকে ফিরিয়ে দেওয়া না যায়, তবে আগামী প্রত্যেকটা বছরেই মানুষের ক্ষতির ‘গ্রাফ’ ঊর্ধ্বমুখীই থাকবে তা আন্দাজ করা যেতেই পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy