১৯৭০ সালে পর্তুগিজ ভাষায় লেখা একটি বই সারা বিশ্বে সাড়া জাগিয়েছিল। ইংরেজি অনুবাদে বইটির নাম পেডাগজি অব দি অপ্রেসড— নিপীড়িতের শিক্ষাতত্ত্ব। লেখক ব্রাজিলের ধর্মযাজক পাওলো ফ্রেইরি (১৯২১-৯৭)। এ বছর এই ঐতিহাসিক বইটি প্রকাশের অর্ধশতবর্ষ। পাওলো ফ্রেইরির জন্মশতবর্ষেরও সূচনা। পাওলোর এই বইটিকে বৈপ্লবিক মনে করা হয়, কারণ বহু কালের পোষিত শিক্ষাভাবনার মূলে আঘাত করে তা একটা দিগন্তর ঘটিয়েছিল। সেই প্রাচীন যুগ থেকে শিক্ষাকে মনে করা হয়েছে দানের বিষয়। শিক্ষক উঁচু বেদি থেকে শিক্ষা বা জ্ঞান প্রদান করবেন, আর শিক্ষার্থী নত হয়ে বিনা প্রশ্নে সেই জ্ঞানের খণ্ড দিয়ে মনের শূন্যপাত্র ভরে নেবে। আমাদের দেশে যেমন গুরুবাক্য ছিল আপ্তবাক্য। বেদ অপৌরুষেয়, স্মৃতিশাস্ত্র অবশ্যমান্য। ইউরোপের আঠারো শতকের জ্ঞানদীপ্তির পরেও মানুষের মনকে ফাঁকা স্লেটের মতো ভাবতে চাইতেন জন লক প্রমুখ দার্শনিক।
পাওলো এই ধারণাকে উল্টে দিয়ে বললেন, শিক্ষা জিনিসটা দান করা বা পুঁজি করে রাখার মতো বস্তু নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কথালাপ আর প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নের ভিতর থেকেই প্রদীপ্ত হয়ে ওঠে নতুন নতুন জ্ঞানের শিখা। প্রচলিত ভাবনার শিক্ষাকে তিনি বললেন আমানতি (ব্যাঙ্কিং) ব্যবস্থা, আর তার বিপরীতে নিয়ে এলেন কথালাপী পদ্ধতি বা ‘ডায়ালজিকাল মেথড’। সক্রেটিসের স্মরণীয় ঐতিহ্য মনে রেখে আরও অনেকটা এগিয়ে তিনি বোঝাতে চাইলেন, শিক্ষা মানে জ্ঞানের পিণ্ড পুঁজি করে রাখা নয়, বরং প্রতিটি শব্দের ভিতর দিয়ে এই বিশ্বের একটি খণ্ডকে হাতের মুঠোয় ধরতে পারা— চেতনার উন্মেষ। তাঁর আর একটি বইয়ের নাম, সাক্ষরতা: শব্দপাঠ ও বিশ্বপাঠ (লিটারেসি: রিডিং দ্য ওয়র্ড অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড), বেরিয়েছিল ১৯৮৭ সালে।
পাওলো কাজ করেছিলেন এই ভাবে— একটি শব্দ, ‘ফ্লাভেলা’ (বস্তি) একটি সঙ্কেত বা কোড। কথালাপের ভিতর দিয়ে সঙ্কেত ভেঙে বেরিয়ে এল: বস্তির ঘর, তার উপাদান, বস্তির মানুষের জীবনযাপন— নতুন নতুন শব্দ ধরে চলে আলোচনা, আর এই ভাবেই তৈরি হয়ে যায় পাঠক্রম। শব্দ এখানে নিরর্থ বর্ণসমষ্টি নয়, অর্থপূর্ণ একটি বস্তু বা ভাবের সঙ্কেত। এই পদ্ধতির সাহায্যে পাওলো ১৯৬৩ সালে একটি গ্রামের সব মানুষকে সাক্ষর করে তুলেছিলেন মাত্র পঞ্চাশ দিনের মধ্যে।
এত সাফল্য সত্ত্বেও ব্রাজিলের স্বৈরাচারী শাসকের নির্দেশে ১৯৬৪ থেকে পনেরো বছরেরও বেশি সময় পাওলোকে নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। তখন তিনি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে শহরে-গ্রামে দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করেছেন। পাওলো বলতেন, ‘‘জিশু আমায় গরিবদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, গরিব মানুষ আমাকে পাঠিয়ে দিল মার্ক্সের কাছে।’’ মার্ক্স-অনুপ্রাণিত পাওলো একাধিক রচনায় বলেছেন, শিক্ষা মানে ‘বিবেকের উন্মেষ’— দরিদ্র মানুষ শিক্ষার ভিতর দিয়ে খুঁজে বার করবে তাঁদের বঞ্চনার কারণ এবং তা থেকে মুক্তির উপায়। তাঁর আর একটি বিখ্যাত বই, এডুকেশন: দ্য প্র্যাকটিস অব ফ্রিডম (১৯৭৬)।
ধরা যাক, ‘ইট’ শব্দটা নিয়ে কথোপকথন চলছে। ইট থেকে ইটভাটা, তা থেকে শ্রমিক নারীপুরুষ, তার পর তাঁদের কাজের পরিস্থিতি, তা থেকে মজুরির হার। কথোপকথন এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে যেখানে অন্যায্য মজুরি, মালিকের শোষণ, শ্রমিক-বঞ্চনা ইত্যাদি বিষয় ধাপে ধাপে এসে যাবেই। এমন শিক্ষাপদ্ধতি কোনও শাসকেরই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। বিকল্প ভাবনাকে রাষ্ট্র সন্দেহের চোখে দেখে। রবীন্দ্রনাথ-গাঁধীজির শিক্ষাভাবনার বিশেষ কদর হয়নি স্বাধীন ভারতেও।
১৯৭২ সালে পেঙ্গুইন থেকে পেডাগজি-র ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৮২ পর্যন্ত প্রতি বছরই নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে পাওলোর কাছে আমন্ত্রণ আসে। ইউরোপ, আমেরিকার কয়েকটি দেশেও পাওলো ফ্রেইরির পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। পাওলোর শিক্ষা চিন্তায় ‘ডায়ালগ’ বা কথালাপের গুরুত্ব সর্বাধিক। ডায়ালগের ভিতর দিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, দু’জনেই নিজেদের বদলাতে পারে।
নির্বাসন পর্বে পাওলো ফ্রেইরি ভারতে এসেছিলেন। তাঁর চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন গাঁধীবাদী শিক্ষাবিদ জে পি নায়েক। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু ছোট ছোট সংগঠন পাওলোর পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন। এই লেখকেরও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। ‘ঘর’ শব্দটি নিয়ে কথা শুরু করে আমরা দেখেছিলাম, কলকাতার ঝুপড়ির শিশুদের আঁকা ছবিতে ঘরের ছাদ গোলাপি বা নীল, যা পলিথিনের চাদরের রং। আবার গ্রামের শিশু বলে, ঘরে শুধু আমরাই থাকি না, হাঁস-মুরগিও থাকে। বয়স্ক নারীর চিত্তবিশ্বে ‘ঘর’ কথাটির ব্যঞ্জনা অনেক গভীর। ঘর আর বাসা এক নয়, ঘর বলতে অনেকেই বোঝেন দেশ। আবার ঘর মানে সংসারও। শব্দটির উচ্চারণে চোখ ছলছল করে ওঠে ঘরহারা যুবতীর। বারবনিতা নারী বলেন, ‘‘ঘর তো এক দিন ছিলই, সেখানে তো আর ফিরতে পারি না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy