Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Mob Lynhing

বিশৃঙ্খল

‘ছেলেধরা’, ‘শিশুচুরি’ ইত্যাদি শব্দগুলি হাওয়ায় ভাসিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিরাট উত্তেজনা সৃষ্টি করার সহজ পন্থা। সন্তানের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা সহজেই এই ফাঁদে পা দিয়ে যুক্তিবুদ্ধি হারান।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২৪ ০৭:৪৬
Share: Save:

গণপ্রহারের ঘটনার সঙ্গে সাধারণত ক্ষণিকের উত্তেজনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। কোনও রটনা অথবা সন্দেহের বশবর্তী হয়ে একত্রে অনেক সংখ্যক মানুষ আইন নিজ হাতে তুলে নিয়ে ‘অপরাধী’কে শাস্তি দিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। কিন্তু সম্প্রতি উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক এলাকায় যে একের পর শিশুচুরির অভিযোগে গণপ্রহারের ঘটনা ঘটছে, তাকে সেই গোত্রে ফেলা যায় না। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনায় আবেগকে উস্কে দিয়ে পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বারাসতের কাজিপাড়ায় বালক খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত নিজ অপরাধ আড়াল করতে অনুগামীদের দ্বারা সমাজমাধ্যমে শিশুচুরির সংবাদ রটিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ‘অপহৃত বালক’-এর অঙ্গ চুরির গল্পও ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর রটনায় বিশ্বাস করেছিলেন অগণিত মানুষ। তারই প্রতিক্রিয়ায় বারাসত-সহ উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে একের পর এক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্ত ধরা পড়েছেন, কিন্তু ঘটনার রেশ অব্যাহত।

‘ছেলেধরা’, ‘শিশুচুরি’ ইত্যাদি শব্দগুলি হাওয়ায় ভাসিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিরাট উত্তেজনা সৃষ্টি করার সহজ পন্থা। সন্তানের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা সহজেই এই ফাঁদে পা দিয়ে যুক্তিবুদ্ধি হারান। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, গণপ্রহার কোনও সভ্য সুশৃঙ্খল সমাজের রীতি হতে পারে না। যেখানে আইন আছে, অপরাধীকে শাস্তিদানের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা আছে, অভিযোগ জানানোর নির্দিষ্ট বিভাগ আছে, সেখানে সেই ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখাই সভ্য নাগরিকের কাজ। অন্যথা হওয়ার অর্থ নাগরিক ধর্ম থেকেই বিচ্যুত হওয়া। এবং একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ-প্রশাসনের শোচনীয় ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ‘গুজবে কান দেবেন না’ গোছের কিছু সচেতনতামূলক প্রচারেই পুলিশের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেন জনতা যে কোনও প্ররোচনায় পা দিয়ে এমন একটি ঘৃণ্য অপরাধ ঘটাচ্ছে, এর পশ্চাতে কোন পরিকল্পনা কাজ করেছে, সেই কারণগুলিও পুলিশকেই খুঁজে বার করতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে তাকে দল-মত-ক্ষমতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। নিরপেক্ষ, কারণ এ দেশে ক্ষমতাসীন, প্রভাবশালীদের প্রতি পুলিশি আনুগত্যের উদাহরণ কম নেই। পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতেই উত্তর ভারতে গোমাংস ভক্ষণ, পাচার, এমনকি বাড়িতে রাখা, এই সন্দেহে একের পর এক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার সেই অন্যায়গুলির ক্ষেত্রেও পুলিশকে যথার্থ আইনরক্ষকের ভূমিকায় দেখা যায়নি।

উত্তর ২৪ পরগনার ঘটনাগুলি থেকে স্পষ্ট, পুলিশ-প্রশাসনের প্রতি নাগরিকের আস্থার বিষয়টি যথেষ্ট ধাক্কা খেয়েছে। এর এক দিকে রয়েছে জনগণের মধ্যে পুলিশের ভাবমূর্তির অবনমন; অন্য দিকে, শিশুপাচার, শিশুচুরির অজস্র অভিযোগ। সুতরাং, সামান্য রটনাই স্ফুলিঙ্গের কাজ করছে। এই আস্থাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পুলিশেরই। পুলিশ যে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি দেয়, এবং একই সঙ্গে নিরপরাধীকেও রক্ষা করে— এই বোধ সাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুধুমাত্র কিছু গ্রেফতারি দিয়ে নয়, ভরসার উপযুক্ত কাজের প্রমাণ দিয়ে, নিজেদের রাজনৈতিক সাহচর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে। অন্যথায় এ-হেন বিশৃঙ্খলা আরও বৃদ্ধি পাবে। নিয়ন্ত্রণহীন সেই সমাজ কোনও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ হতে পারে না।

অন্য বিষয়গুলি:

Kidnapping
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy