ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধে আমেরিকার কতখানি ক্ষতি, ভারতের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহল আপাতত সেই প্রশ্নে মনোনিবেশ করেছে। মহামন্দা-উত্তর স্মুট-হলি ট্যারিফ অ্যাক্টের উদাহরণ টেনে মনে করিয়ে দিতে চাইছে, বাণিজ্যের পথ রুদ্ধ করে সে বার শেষ অবধি আমেরিকার ভাল হয়নি— এ বারও হবে না। কথাটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু, আমেরিকার যদি ক্ষতি হয়ও, তাতে ভারতের ক্ষতি পূরণ হবে না। ইতিমধ্যেই ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের ভারতীয় রফতানির উপরে ২৫% শুল্ক বসেছে। ২ এপ্রিলের পর বোঝা যাবে যে, আরও কোন কোন ক্ষেত্রে চড়া শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে ভারতকে। ইতিমধ্যেই সংশয়ের মেঘ জমেছে ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রের উপরে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় সরকার— এখনও অবধি তা যে খুব ফলপ্রসূ হয়েছে, তেমন দাবি করা অবশ্য মুশকিল। এ ক্ষেত্রে একটা কথা খেয়াল করার মতো— ট্রাম্পের আক্রমণের মুখে পড়েছে যে দেশগুলি, সেগুলির প্রতিক্রিয়া দ্বিমুখী। ইইউ বা কানাডার মতো দেশগুলি ইতিমধ্যেই পাল্টা শুল্ক চড়িয়েছে। আবার, ভারতের মতো দেশ আমেরিকান রফতানি বিষয়ে নরম নীতি নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রী নাকি ভারতীয় উৎপাদকদের চিনা আমদানি বাদ দিয়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমেরিকা থেকে আমদানি করা অন্তর্বর্তী পণ্য ব্যবহার করতে বলেছেন। প্রতিক্রিয়ার এই বিভিন্নতার পিছনে একটিই মাত্র কারণ আছে, তা না-ই হতে পারে— কিন্তু, রফতানির বাজারে কোন দেশের কোমরের জোর কতখানি, এতে তার প্রতিফলন ঘটেছে। ভারতের অবস্থান সে কারণেই উদ্বেগজনক।
আমেরিকায় যত পণ্য আমদানি করা হয়, তার আড়াই শতাংশেরও কম আসে ভারত থেকে। আবার, আমেরিকার মোট রফতানির আড়াই শতাংশের কাছাকাছি যায় ভারতে। অর্থাৎ, আমেরিকার বাণিজ্যসঙ্গী হিসাবে ভারত নিতান্তই ছোট মাপের। কিন্তু, ভারতের মোট রফতানির প্রায় এক-পঞ্চমাংশের গন্তব্য আমেরিকা। স্পষ্টতই, আমেরিকার কাছে ভারত যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের কাছে আমেরিকা তার চেয়ে ঢের বেশি। এবং, সেই সামগ্রিক গুরুত্বের চেয়েও বেশি কয়েকটি বিশেষ রফতানি ক্ষেত্রের আমেরিকা-নির্ভরতা। এই অবস্থায় আমেরিকার রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার পথ হতে পারত আমেরিকান পণ্যের উপরে আমদানি শুল্ক হ্রাস করা। কিন্তু, সে পথেও বাধা রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত অনুসারে, ভারতকে যদি আমেরিকান আমদানির উপরে শুল্ক হ্রাস করতে হয়, তবে সংস্থার সদস্য অন্য দেশগুলির ক্ষেত্রেও সেই হারে শুল্ক আরোপ করতে হবে। অন্য পথটি হল ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ বাণিজ্য চুক্তি। কিন্তু তার জন্য সম্ভবত এ বছরের শেষ অবধি অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং, আপাতত শুল্ক-যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বহন করা ভিন্ন ভারতের উপায় নেই। ইতিমধ্যেই কয়েকশো কোটি ডলারের ভারতীয় ইস্পাত আমেরিকার বাজারের উদ্দেশে রওনা দিয়ে আপাতত সমুদ্রে রয়েছে। তার ভবিতব্য কী, সে অনিশ্চয়তাও এখনও কাটেনি।
বর্তমান পরিস্থিতিটি নিঃসন্দেহে মোদী সরকারের বাণিজ্যনীতি তথা বিদেশনীতির ব্যর্থতা। দক্ষিণ এশিয়া অথবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারগুলিতে ভারতের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। আসিয়ান দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার কাজটি অসম্পূর্ণই থেকে গিয়েছে। ভারতের বাণিজ্যনীতি প্রয়োজনের চেয়ে অধিক পরিমাণে আমেরিকা-নির্ভর হয়েছে। বাণিজ্যনীতির ক্ষেত্রে ভারত রক্ষণশীল হবে, না কি উদারপন্থী হবে, গত দশ বছরে সেই দোলাচল অব্যাহত থেকেছে— দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তি বা আঞ্চলিক বাণিজ্যিক চুক্তি প্রণয়নের কাজটি গুরুত্ব পায়নি। ভারত তার বাণিজ্যনীতির পুনর্মূল্যায়ন করুক, এটাই দেওয়ালের লিখন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)