আদালত এবং প্রশাসনের সম্পর্কে টানাপড়েন থাকবে, এটা অস্বাভাবিক নয়, বরং এটাই গণতন্ত্রের অন্যতম প্রকরণ— রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ তাদের পারস্পরিক আদানপ্রদান, নজরদারি এবং সংশোধনের মধ্য দিয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে চলবে, যাতে কোনও একটি অঙ্গ অন্যদের তুলনায় অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী না হয়ে ওঠে। এই আদর্শ অবস্থাটি থেকে বাস্তব অনেক সময়েই অনেক দূরে সরে যায়, ভারসাম্যের হানি হয়, তখন বিপত্তি দেখা দেয়। এই সমস্যার একটি পরিচিত রূপ হল বিচারবিভাগের ‘অতিসক্রিয়তা’। যে কাজ প্রশাসনের বা আইনসভার করার কথা, সেই কাজে বিচারবিভাগ হস্তক্ষেপ করছে, এই অভিযোগ এ দেশে বহুচর্চিত। মাত্র কয়েক দিন আগেও রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন এবং বিচারবিভাগের মন্ত্রীর মন্তব্যে সমালোচনার সুর শোনা গিয়েছে, ‘লক্ষ্মণরেখা’ মেনে চলার পরামর্শও অশ্রুত থাকেনি। বিচারপতিরা হয়তো কখনও কখনও বাস্তবিকই অতিসক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সাধারণ ভাবে বললে ভুল হবে না যে, প্রশাসন এবং আইনসভা নিজের নিজের কাজ ঠিকমতো সম্পাদন করলে বিচারবিভাগকে এত বেশি ‘হস্তক্ষেপ’ করতে হত না। যথা, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের মতো স্পষ্টত গণতন্ত্র-বিরোধী আইন বাতিল করার সৎ উদ্যোগ এত দিন কেন হয়নি, তার সদুত্তর কিন্তু ‘লক্ষ্মণরেখা’-বিশারদ প্রাজ্ঞ আইন ও বিচার মন্ত্রী দেননি। কিংবা, দেশের এবং রাজ্যের সর্ব স্তরে প্রশাসন কেন মানবাধিকারের, এমনকি সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলির সুরক্ষায় যথেষ্ট তৎপর হয় না, এমনকি দেশের আইনগুলি পর্যন্ত মেনে চলার দায় স্বীকার করে না— দেখে বিপর্যস্ত লাগে। এ দেশে বিচারবিভাগকে যদি অতিসক্রিয় হতে হয়, সেটা অন্য বিভাগগুলির চূড়ান্ত অকর্মণ্যতার কারণেই। ।
এ পর্যন্ত চেনা কথা, বস্তুত, পুরনো কথা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং যা ঘটছে তাকে ‘পুরনো কথা’ বললে সত্যের অপলাপ হবে। আদালত না বললে প্রশাসনের কর্তারা কোনও কাজই করেন না। নাগরিক আদালতে মামলা না করা পর্যন্ত নিজেরা আইন-বিধি-বিধান সমানে ভাঙতে ভাঙতে চলেন। ভাবটা এই, দেখি তো, নাগরিক সরকারকে আইন মানতে বাধ্য করতে পারে কি না! সম্প্রতি শিক্ষা দফতর সংক্রান্ত তেত্রিশ কোটি অনিয়মের ক্ষেত্রে, আদালত যে ভাবে লাগাতার প্রশাসনকে তিরস্কার করতে বাধ্য হচ্ছে এবং শাসকরা তাতে কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে সেই অনুশাসনকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, সে নির্লজ্জতা এই রাজ্যেও কোনও কালে এতটা প্রকট ছিল না। আদালতের কড়া নির্দেশের পরে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী যে ভাবে অপরাহ্ণবেলায় সিবিআইয়ের সামনে হাজির হলেন, তাতে সরকারের লজ্জায় অধোবদন হওয়ার বিলক্ষণ হেতু আছে।
লজ্জাবোধ বা অন্তত স্বাভাবিক ন্যায়বোধ যদি থাকে, তা হলে শিক্ষক নিয়োগে এমন অকল্পনীয় দুর্নীতির অগণিত অভিযোগ এবং সেই প্রশ্নে আদালতের একের পর এক কঠোর নির্দেশ ও মন্তব্যের পরে রাজ্য সরকারের নতজানু হয়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত ছিল— কেবল আদালতের কাছে নয়, কেবল শিক্ষক ও শিক্ষক পদের প্রার্থীদের কাছে নয়, সমস্ত রাজ্যবাসীর কাছে। যে ভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে সিবিআই তথা কেন্দ্রীয় তদন্তের দাবি উঠছে, তাতে বোঝা যায়, নাগরিকের আজ সরকারের উপর আস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বোঝা যায় যে, পুলিশ-প্রশাসন স্বার্থান্ধ দুর্নীতিতে ও আইনলঙ্ঘনে নিমজ্জিত, এই বিশ্বাস সমাজের কোণে কোণে কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে। আদালতের প্রবল সক্রিয়তা এবং তীব্র প্রতিক্রিয়ায় একটিই বার্তা উজ্জ্বল— রাজ্যে প্রশাসন নামক বস্তুটির কাঠামোয় ঘুণ ধরে গিয়েছে। শাসকরা তা স্বীকার না করলে আদালতের কোনও তিরস্কারেই শুদ্ধির আশা নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy