E-Paper

জনাদেশের সত্য অর্থ

জনাদেশ শব্দটি অধুনা বাংলা ভাষায় উত্তরোত্তর প্রচলিত হচ্ছে। তাতে ক্ষতি নেই, বরং লাভ। নির্দিষ্ট ধারণার বাহক হিসাবে নির্দিষ্ট শব্দকে গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারলে ভাষা কেবল সমৃদ্ধ হয় না, অগ্রসর হয়।

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৪ ০৮:২৭
Share
Save

গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সামগ্রিক ফলাফল এবং সেই ফলাফল থেকে উঠে-আসা জনমতের গতিপ্রকৃতিকে বোঝানোর জন্য— অর্থাৎ ‘ম্যানডেট’-এর প্রতিশব্দ রূপে— জনাদেশ শব্দটি অধুনা বাংলা ভাষায় উত্তরোত্তর প্রচলিত হচ্ছে। তাতে ক্ষতি নেই, বরং লাভ। নির্দিষ্ট ধারণার বাহক হিসাবে নির্দিষ্ট শব্দকে গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারলে ভাষা কেবল সমৃদ্ধ হয় না, অগ্রসর হয়। আবার, সেই এগিয়ে চলার পথেই উঠে আসে নতুন প্রশ্ন। কিংবা, পুরনো প্রশ্নের উপর এসে পড়ে নতুন আলো। যেমন, জনাদেশ শব্দটিকে ভাল করে নজর করলে সচেতন নাগরিকের মনে নতুন করে জেগে উঠতে পারে এক পুরনো জিজ্ঞাসা: জন বা জনতার আদেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়? দুনিয়ার সর্বাধিক জনবহুল দেশে সদ্য-সম্পন্ন সাধারণ নির্বাচনে মত জানানোর অধিকার পেয়েছেন প্রায় একশো কোটি নাগরিক, ভোট দিয়েছেন অন্তত ৬৪ কোটি। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানে সমাকীর্ণ এই অকল্পনীয় বৈচিত্রের ভারততীর্থে কোন মন্ত্রবলে খুঁজে পাওয়া যাবে সেই ‘জনতা’কে, যে তার দেশকে আদেশ করে, ‘অতঃপর তুমি এই পথে চলবে’?

এই প্রশ্নের একটি সহজ উত্তর: সংখ্যাগরিষ্ঠতার মন্ত্র। অর্থাৎ, সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতকেই জনতার মত বলে শিরোধার্য করতে হবে; তারই নাম গণতন্ত্র। উত্তরটি কেবল সহজ নয়, অতিসরল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অবশ্যই মূল্যবান, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের কাজ চালানোর পক্ষে কার্যত অপরিহার্য। কিন্তু কাজ চালানো এক কথা, আর গভীর ও মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আর এক কথা। প্রথমত, ওয়েস্টমিনস্টার ঘরানার নির্বাচনীব্যবস্থায় জনাদেশের জোরে যাঁরা দেশ চালানোর ক্ষমতা হাতে পান, তাঁরা সচরাচর অধিকাংশ নাগরিকের সমর্থন ভোগ করেন না, কেবল তাঁদের জনসমর্থনের অনুপাত অন্য প্রতিযোগীদের থেকে বেশি থাকে। কাজ চালানোর খাতিরে সর্বাধিক গরিষ্ঠতাকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলে স্বীকার করতে হলেও বিজয়ী শিবিরের সমর্থকমণ্ডলীকেই জনতা বলে মেনে নেওয়ার কোনও যুক্তি নেই, তাঁরা জনতার একটি অংশমাত্র। দ্বিতীয়ত, যাঁদের সমর্থনের জোরে ক্ষমতার রশি বিজয়ী শিবিরের হাতে এল, তাঁরাও কি সমস্বরে কোনও আদেশ দেন? দিতে পারেন? দেওয়া সম্ভব? সত্য কথাটি তাই সাফ সাফ বলাই ভাল: সর্বাধিক সমর্থনকে যদি জনাদেশের ভিত্তি বলে মানতে হয়, তবে সেই আদেশের উৎসে কোনও নির্দিষ্ট, স্পর্শগ্রাহ্য, দ্ব্যর্থহীন ‘জনতা’কে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

তা হলে কি নির্বাচনী সাফল্যকেই জনাদেশের একমাত্র অর্থ বলে মানতে হবে? মেনে নিতে হবে যে, প্রচলিত নির্বাচনীব্যবস্থায় পাটিগণিতের অঙ্ক মিলিয়ে যারা অন্যদের থেকে বেশি আসন সংগ্রহ করতে পারে তারাই অর্জন করে জনাদেশের একচেটিয়া ঠিকাদারি? তাদের আদেশই শাসনতন্ত্রের শেষ কথা, তার বাইরে বৃহত্তর কোনও আদর্শ বা অনুজ্ঞা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই? কখনওই নয়। গণতন্ত্রে জনতা এবং জনাদেশের ধারণা কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, মৌলিক এবং অপরিহার্য। কিন্তু পাটিগণিতে তার হদিস মিলবে না, তাকে খুঁজতে হবে রাজনীতির গভীরে। কার্যসিদ্ধির রাজনীতি নয়, সমাজের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে এবং সেই বাস্তবের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলার রাজনীতি। ‘এগিয়ে চলা’ কথাটির কোনও অবিসংবাদিত এবং পূর্বনির্ধারিত অর্থ হয় না— কেতাবে-লেখা ‘প্রগতিশীলতা’র উপাসনার পরিণাম কী দাঁড়ায়, সে-কথা বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু একটি বাস্তব পরিস্থিতিতে ক্ষমতাবানের অন্যায় ও অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে দুঃশাসনকে প্রতিহত করার যে রাজনীতি, গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে তা নিঃসন্দেহে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, কারণ তার মধ্য দিয়েই নাগরিকরা শাসনতন্ত্রের উপর আপন অধিকার বুঝে নিতে পারেন। সুতরাং, একটি নির্বাচন যখন ক্ষমতার আধিপত্যের বিরুদ্ধে জনসমাজের আত্ম-অধিকারের দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, ক্ষমতাবানের দখল থেকে সেই অধিকার ষোলো আনা না হলেও কিছুটা ফিরিয়ে আনতে পারে জনসাধারণের হাতে, তখন তার ফলাফল হয়ে ওঠে প্রকৃত অর্থেই জনাদেশ। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন ঠিক এই কারণেই নিজেকে ঐতিহাসিক বলে প্রমাণ করতে পেরেছে। তৃতীয় বার ক্ষমতায় আসা বা শরিকদের হাতে রেখে সরকার গঠন করার কৃতিত্ব সেই ইতিহাসের পাদটীকামাত্র। এই নির্বাচনের ঐতিহাসিকতা এখানেই যে, তা জনাদেশের সত্যমূল্য পুনরুদ্ধার করেছে। পাটিগণিত-সর্বস্ব আধিপত্যবাদীরা সেই মূল্য বুঝবেন না, বুঝতে পারবেন না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Indian Democracy democratic system Democracy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।