একে একে ঘরে ফিরছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। — ফাইল চিত্র।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে কী করে ভোট দেবেন গ্রামের বাইরে কর্মরত রাজ্যের নাগরিকরা? ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগটি কি কেবল কাজ করার অপরাধে তাঁরা খোয়াবেন? সংবাদ বলছে, জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বন্ধ রায়পুর চা-বাগানের প্রায় দেড় হাজার শ্রমিককে ভোট দেওয়ানোর জন্য বাগানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন শাসক দলের নেতা-কর্মীরা। এমনই হতদরিদ্র এই মানুষগুলি যে, নিজেদের টাকায় ঘরে ফিরে আসার ক্ষমতা তাঁদের নেই, তাই শাসক দলই উদ্যোগী হয়ে কিছু করতে চাইছে। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের কত জন এমন কোনও সহায়তা পাবেন? যেখানে এঁরা কাজ করছেন, সেখান থেকেই যাতে তাঁরা ভোট দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল। সেই ব্যবস্থা নানা উপায়ে হতে পারত। ডাকের মাধ্যমে ভোট (পোস্টাল ব্যালট) দেওয়ার সুযোগ দেওয়া যেতে পারত, যেমন দেওয়া হয় ভিনরাজ্যে নির্বাচনী কাজে নিযুক্ত সরকারি কর্মীদের, সেনাবাহিনীর সদস্যদের। অথবা, যে সব রাজ্যে কাজ করছেন পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরা, সেখানকার রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে কিছু নির্দিষ্ট ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা যেতে পারত। আধুনিক বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো যায়, এবং তার জন্য প্রয়োজনে আইনও বদলাতে হতে পারে। উপায় নির্ধারণ করার কথা ছিল সরকারেরই। অথচ সেই দায়িত্বের কথা যথাসময়ে ভাবা হয়নি বলে বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিকদের কার্যত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এক জন নাগরিকের সঙ্গেও রাষ্ট্র তেমন আচরণ করতে পারে না। প্রান্তিক এলাকাতে, অল্প কয়েকটি মানুষের জন্যেও ভোটগ্রহণের বুথ তৈরি হয়। পরিযায়ী শ্রমিকরা আর কত দিন উপেক্ষিত হবেন?
সরকারি হিসাব অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা আটত্রিশ লক্ষ। বেসরকারি হিসাবে সেই সংখ্যাটা এর দেড়গুণও হতে পারে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ গেরস্তালির সংখ্যা এক কোটি সাঁইত্রিশ লক্ষ। অতএব রাজ্যের এক বড় সংখ্যক ঘরের কেউ না কেউ রয়েছেন বাইরে। সুন্দরবন থেকে শিলিগুড়ি, বসিরহাট থেকে বান্দোয়ান, রাজ্যের যে কোনও গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলে মিলবে বেশ কিছু পরিবারের, যার সদস্যরা রোজগারের খোঁজে গিয়েছেন অন্য জেলায়, অন্য রাজ্যে, এমনকি বিদেশে। এঁদের ক’জনই বা ভোট দিতে আসতে পারবেন? অধিকাংশই কাজ করেন চুক্তির ভিত্তিতে, যে চুক্তির শর্ত নিয়ে দরদস্তুর করার সাধ্য তাঁদের নেই। অসময়ে ছুটি, বা দীর্ঘ ছুটি নিতে গেলে কাজ হারানোর সম্ভাবনা। সেই সঙ্গে রয়েছে বাড়ি আসার খরচ। ভোটাধিকারের সুরক্ষাই ভোটগ্রহণের নতুন ব্যবস্থার একমাত্র যুক্তি নয়। পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের প্রয়োজনগুলি যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তথা রাজ্য সরকারের দ্বারা উপেক্ষিত হয়, তার অন্যতম কারণ এই যে, তাঁরা ভোটের ময়দানে একটি পৃথক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারছেন না। তা যদি পারতেন, তা হলে এক দিকে যেমন পরিযায়ীদের সুরক্ষায় সরকারকে তৎপর হতে হত, অন্য দিকে তেমনই গ্রামে বাসরত মহিলা-প্রধান পরিবারগুলির প্রয়োজনের প্রতি সজাগ হতে হত।
প্রতিটি নাগরিক যাতে ভোট দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করার কথা রাষ্ট্রেরই। দরিদ্র মানুষের ঘাড়ে ভোট দিতে আসার খরচ চাপানো হবে কেন? বিভিন্ন জনসভা থেকে বড় বড় নেতা-নেত্রীরা ভোট দেওয়ার জন্য বাড়ি আসার ডাক দেন পরিযায়ীদের। অথচ, বাড়ি না এসেও ভোট দিতে পারার ব্যবস্থা করার দরকার ছিল তাঁদেরই। এটা সময়ের দাবি। অনেক দেশেই এখন দূরভোট ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আমেরিকার সাম্প্রতিকতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটি ঘটেছিল ২০২০ সালে, যে সময়ে করোনার প্রকোপ ছিল পুরোদমে। ডাক ব্যবস্থার মাধ্যমে ভোট পাঠানোর ব্যবস্থা অনেকখানি সম্প্রসারিত করা হল সে দেশে ওই সময়ে। ভারতেও এত দিনে তা করা যেত। প্রয়োজন ছিল কেবল, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy