Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Information Bank

তথ্যের তরবারি

স্কুলপড়ুয়ারা হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই নিবন্ধ রচনা করবে: ‘তথ্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?’— পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তির অভাব ঘটবে না।

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৬:২৬
Share: Save:

একবিংশ শতাব্দী যে তথ্যের শতাব্দী, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশমাত্র নেই। বিধ্বংসী যুদ্ধ থেকে ঘর সাফাইয়ের বট, সবই চালিত তথ্যের জ্বালানিতে। স্কুলপড়ুয়ারা হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই নিবন্ধ রচনা করবে: ‘তথ্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?’— পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তির অভাব ঘটবে না। ইতিহাস ও প্রযুক্তিবিষয়ক জনপ্রিয় লেখক ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর নতুন বইয়ে (নেক্সাস: আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইনফর্মেশন নেটওয়ার্কস ফ্রম দ্য স্টোন এজ টু এআই, র‌্যান্ডম হাউস, ২০২৪) তেমনই কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই বিতর্ককে নিয়ে গিয়েছে সম্পূর্ণ নতুন একটি স্তরে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম বার যন্ত্র স্বাধীন ভাবে ভাবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। তার আগে অবধি মানুষ যত ভয়ঙ্কর আবিষ্কারই করে থাকুক, তার কোনওটার সামর্থ্য ছিল না স্বাধীন ভাবে মানুুষের ক্ষতি করার— কোন জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত হতে হবে, তা স্থির করার সাধ্য ছিল না পরমাণু বোমার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সেই শক্তি আছে। মানুষই তাকে সেই শক্তি জুগিয়েছে। এখন দুনিয়ার প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের একাংশ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, এমন দিন আসতে পারে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সমগ্র মানবজাতির দ্বন্দ্ব বাধবে, এবং মানুষের তাতে জেতার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। এর জন্য হলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্য কল্পনা করার প্রয়োজন নেই— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যে ভাবে মানুষকে চার পাশ দিয়ে ঘিরে ধরছে, যে ভাবে তার ভাবনার খাতগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে কোনও এক সময় তা হয়ে উঠতে পারে এক অ-মানবিক একনায়ক। সমগ্র মানবসভ্যতার উপর অবিমিশ্র নিয়ন্ত্রণ যার লক্ষ্য। এমন আশঙ্কা কত দূর সত্য, তা ভবিষ্যৎই বলবে, কিন্তু অন্য একটি আশঙ্কা ইতিমধ্যেই প্রায়-বাস্তব— বিভিন্ন বিভেদকামী রাজনৈতিক শক্তির হাতে ব্যবহারের ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘৃণার বাস্তুতন্ত্র নির্মাণের খেলার যে প্রতিভা প্রদর্শন করেছে, তা চরমতর আকার ধারণ করলে সেটাই হয়ে উঠতে পারে মানবসভ্যতার কফিনে শেষ পেরেক।

তথ্য-নির্ভর ডিসটোপিয়ার এটিই একমাত্র ঠিকানা অবশ্য নয়। গত শতকের শেষার্ধে যখন তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার ঘটছে, তখন সেই ‘বিপ্লব’-এর একটি অনুচ্চারিত বৈশ্বিক স্লোগান ছিল— তথ্যই পারে সব অন্ধকার মোচন করতে, তথ্যই পারে মানবসভ্যতাকে সত্যের পথে নিয়ে যেতে। কোনও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান যদি তথ্য গোপন করে ক্রেতাদের ঠকায়, তবে ক্রেতার হাতে আরও তথ্যের অধিকারই পারে সেই অসৎ ব্যবসায়িক উদ্যোগকে স্তব্ধ করতে; কোনও নেতা যদি তথ্য বিকৃত করে তাঁর শাসনাধীন জনগোষ্ঠীকে বিপজ্জনক পথে চালিত করতে চান, তা হলে সেই মানুষের হাতে অবাধ তথ্য পৌঁছে দেওয়াই হতে পারে গণতন্ত্র রক্ষার প্রকৃষ্টতম পথ— অন্তত, সে দেশের মাটির নীচে যদি পেট্রলিয়ামের ভান্ডার না থাকে, তবে। আধুনিকতার সেই ‘নিষ্পাপ’ দর্শন ক্রমেই মিইয়ে পড়ছিল— গত এক দশকের উত্তর-সত্য জমানায় সে বালাই সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে। তথ্যের সঙ্গে সত্যের— বিশেষত, নিষ্পক্ষ সত্যের— সম্পর্কটি অস্বীকার করেছে নব্য জনবাদী রাজনীতি। যে কোনও তথ্যের পিঠেই ভেসে আসে প্রশ্ন— এই তথ্য কার স্বার্থপূরণে সহায়ক? এই তথ্য কার ‘সত্য’কে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়? যে তথ্যকে ভাবা হয়েছিল একক সত্যে পৌঁছনোর পথ, তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অবিশ্বাসের আয়ুধ।

সেই আয়ুধ স্বভাবতই ব্যবহৃত হয় রাজনীতিকদের হাতে। কোথাও ডোনাল্ড ট্রাম্প, কোথাও জাইর বোলসোনারো, কোথাও আবার নরেন্দ্র মোদী ক্রমাগত জানাতে থাকেন, সব স্বার্থগোষ্ঠীর তৈরি করা বিভ্রান্তির জট কাটিয়ে মানুষকে একমাত্র তাঁরাই দিতে পারেন সত্যের সন্ধান। একবিংশ শতকের রাজনীতি সাক্ষী, এই কথাটিতে সাধারণ মানুষ বিশ্বাসও করেছে। ফলে, তথ্য বা তার প্রতি (অ)বিশ্বাস তৈরি করেছে ব্যক্তিপূজার এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নয়, মানুষের উন্নতি নির্ভর করে কোনও এক ‘অসীম-শক্তিধর’ নেতার উপরে। খাতায়-কলমে যা-ই হোক না কেন, প্রকৃত প্রস্তাবে সে ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নয়, হতে পারে না। অর্থাৎ, প্রথম বিশ্ব একদা যে তথ্যকে দেখেছিল বৈশ্বিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ হিসাবে, উত্তর-সত্য রাজনীতি তাকে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চালিত করতে পেরেছে। অতএব বলা যায়, একবিংশ শতকের কাছে প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হল, মানুষই হোক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, কারও হাতেই যাতে তথ্যের বিকৃত ব্যবহার না ঘটে, তথ্য যাতে মানবসভ্যতার শত্রু না হয়ে দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করা। কাজটি কঠিন, তাতে সন্দেহ নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Information Bank internet Knowledge
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy