জাতীয় সংসদে বিতর্ককালে সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জলের বোতল ভাঙা এবং তার জেরে নিজেই রক্তাক্ত হয়ে পড়ার ঘটনা ইতিমধ্যেই দেশময় প্রচারিত। তৃণমূল কংগ্রেস দল হিসাবে গৌরব বোধ করতে পারে, দলীয় সাংসদ এ-হেন আশ্চর্য দৃশ্য তৈরি করতে পেরেছেন বলে! পশ্চিমবঙ্গও বিশিষ্ট বোধ করতে পারে, এই রাজ্যের জনপ্রতিনিধিরা দেশের সামনে রাজ্যের ঠিক কী ছবি তুলে ধরছেন, সে কথা ভেবে। ঠিকই, এই সভ্যতাবিবর্জিত আচরণ কেবল পশ্চিমবঙ্গীয়দের বৈশিষ্ট্য নয়, কোনও একক দলের সম্পত্তিও নয়। তবু কিছু অঞ্চল নিয়মিত ভাবে এই ধরনের কাজের উদাহরণ দিয়ে থাকে, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ পড়বেই। নেতাদের ব্যবহারের সঙ্গে রাজ্যের সম্মানের বিষয়টি জড়িয়ে, এই সত্য মাথায় রাখার দায় বঙ্গীয় নেতাদের আছে বলে মনে হয় না। দলীয় নেতৃত্বেরও দায় নেই প্রতিনিধিদের শাসন করার, কেননা কোনটি সদাচার কোনটি কদাচার এ নিয়ে তাঁদের ধারণাও ক্ষীণ ও সীমিত!
আরও একটি কথা। সে দিনের বিতর্কের বিষয় ছিল, ওয়াকফ জমি ও তার মালিকানা সংক্রান্ত সংশোধনী সংস্কার। কেন্দ্রীয় শাসক দলের প্রস্তাবিত ওয়াকফ সংস্কারের বিরুদ্ধে উচ্চৈঃস্বরে যুক্তির অবতারণা করতে গিয়ে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই যে কুকর্মটি করলেন, তাতে কেবল রাজ্যবাসীর অসম্মান হল না, ভারতীয় সংখ্যালঘু সমাজের জন্যও তা অমঙ্গলজনক হল। এমনিতেই একটি তীব্র বিভাজক বিষয়ের মধ্যে সাংসদ মহাশয়ের দৌলতে প্রবিষ্ট হয়ে গেল অতিরিক্ত বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের তীক্ষ্ণতা। যাঁরা সংখ্যালঘুবিরোধী, তাঁরা প্রচার করতে পারলেন যে ওয়াকফ বোর্ড বিতর্কে সংখ্যালঘু স্বার্থের পক্ষে যে রাজনীতিকরা কথা বলেন, সেই নেতারা কেবল সংখ্যালঘু তোষণকারী নন, নিজেরাও ‘অসামাজিক’, বিশৃঙ্খল। বাস্তবিক, বিষয়টি এতই সংবেদনশীল যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও আগ্রহের কথা ভেবেই জনপ্রতিনিধির উচিত ছিল মর্যাদা ও সচেতনতার সঙ্গে নিজেদের সংসদীয় দায়িত্ব পালন করা। তালাক প্রথার অবলোপের পর আবার এই সংস্কারটির সূত্রে গত আড়াই মাস ধরে মুসলিম সমাজের নিজস্ব বিধিবিধান নিয়ে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ হয়েছে। কাণ্ডজ্ঞানবিহীন দুর্বিনীত সাংসদ মহাশয় তার মধ্যে এই অকারণ কুনাট্যের অবতারণা না করলেই পারতেন।
অগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সংসদীয় ও সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে দু’টি বিল পেশ করেন, একটি ওয়াকফ সংশোধনী বিল, অন্যটি মুসলিম ওয়াকফ রিপিল বিল। একটি জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি তৈরি হয়, যার একাধিক বৈঠকে উত্তপ্ত সংঘর্ষময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। বর্তমানে দেশব্যাপী বিপুল পরিমাণ জমি ওয়াকফ হিসাবে চিহ্নিত, যা সরাসরি ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন, তার কেনাবেচা ভূমিরাজস্ব সব কিছুর অধিকারই বোর্ডের হাতে। সংশোধনী বিল পাশ হলে সেই নিয়ন্ত্রণের অনেকাংশ চলে আসবে সরকারের অধীনে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর সঙ্গে কেবল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রশ্নটিই যুক্ত নয়, আছে রাষ্ট্রীয় পরিসরের সঙ্গে সামাজিক সংগঠনের সম্পর্ক কায়েমি স্বার্থের প্রশ্নও। ওয়াকফ জমি থেকে নিয়মমতেই মুসলমান সমাজের নানাবিধ সামাজিক জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়ের একটি ধারাবাহিক ঐতিহ্য রয়েছে, তবে সেই বিপুল সংগৃহীত অর্থের সবটাই যে যথাযথ ভাবে ব্যয়িত বা ব্যবহৃত হয় না, তাও ইতিমধ্যে প্রমাণিত। সাচার কমিটি রিপোর্টে (২০০৬) স্পষ্ট তথ্যপ্রমাণ মিলেছিল ওয়াকফ হিসাব গরমিলের। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি সমর্থিত বিলটি গুরুত্বপূর্ণ, এবং তা নিয়ে বিরোধী দলের আপত্তি ও সমালোচনারও কম গুরুত্ব নেই। উত্তেজনা ও আক্রমণ পরিহার করে রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টিকে দায়িত্বসহকারে আলোচনা করুন, জনপরিসরে এ বিষয়ে সচেতন মতামত তৈরি করুন, এটাই তাঁদের প্রকৃত কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy