Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Threat Culture

সর্বগ্রাসী

তৃণমূল-শাসনে এই হুমকি-প্রথাভিত্তিক খাজনা আদায়ের সংস্কৃতিটি সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী হয়েছে। তবে, বঙ্গভূমে এই প্রথার উৎপত্তিও তৃণমূল আমলেই ঘটেছে, এ কথা বললে সিপিএমের লোকাল কমিটির প্রেতাত্মাগুলিও অট্টহাস্য করে উঠবে।

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:৩৪
Share: Save:

রাজ্য রাজনীতি আপাতত একটি শব্দবন্ধে সরগরম— থ্রেট কালচার বা হুমকি-প্রথা। আর জি কর-কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনায় উঠে এসেছিল কথাটি। তার পর ক্রমে প্রকাশিত হল যে, শুধু আর জি কর নয়, শুধু মেডিক্যাল কলেজগুলিও নয়, এমনকি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রও নয়— এই হুমকি-প্রথা কার্যত রাজ্যের প্রতিটি পরিসরে কাজ করে চলেছে। তার কার্যপদ্ধতিটিও ক্ষেত্র-নির্বিশেষে অভিন্ন— যারা হুমকি দেয়, তারা প্রত্যেকেই শাসক দলের কোনও ক্ষমতাবান শিবিরের সঙ্গে যুক্ত; এমন শিবির, যাদের পক্ষে চাইলে কারও ক্ষতি করা সম্ভব, অথবা তা সম্ভব বলে একটি ধারণা বাজারে প্রচলিত আছে। হুমকি-প্রথা হল সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অন্যায্য ‘খাজনা’ আদায়ের পদ্ধতিবিশেষ। অর্থাৎ, হুমকি-প্রথা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো নয়ই, তা এমনকি কোনও পৃথক বস্তুও নয়— পশ্চিমবঙ্গের সর্বস্তরে যে ‘খাজনা’ আদায়ের ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, হুমকি-প্রথা তারই একটি বিশিষ্ট রূপ। বস্তুত, হুমকি বিনা কোনও ক্ষেত্রেই অবৈধ খাজনা আদায় করা মুশকিল। যে বস্তুটি কারও কাছে প্রাপ্য নয়, তা যদি কেড়ে নিতে হয়, সে ক্ষেত্রে ছল অথবা কৌশলের তুলনায় বল-এ অনেক সহজে কাজ হয়— অন্তত শাসক দলের বাহুবলীদের তেমনই ধারণা। আর জি কর-কাণ্ডের প্রাবল্যে সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান বা চোপড়ার জেসিবি-র মতো বাহুবলীদের কথা আলোচনার বাইরে চলে গিয়েছে। সেই শাসকাশ্রিত গুন্ডাদের সঙ্গে আর জি করের হুমকি দিয়ে বেড়ানো ‘ডাক্তার-মস্তান’ অথবা টালিগঞ্জ চলচ্চিত্র শিল্পের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক শাসক দলের নেতার চরিত্রগত প্রভেদ নেই। জেসিবির মতো গুন্ডা হাতে মারে; শহরের পরিশীলিত শিক্ষা বা শিল্পজগতের হুমকিদাতারা মূলত ভাতে মারার কথা বলে থাকেন। প্রয়োজনে তাঁদের হাতও যে চলে না, সে দাবি অবশ্য করা যাবে না। যে সব জায়গায় তাঁরা প্রত্যক্ষ আর্থিক খাজনা আদায় করেন না, সেখানে আনুগত্য আদায় করেন— আর্থিক খাজনা আদায়ের পথে কেউ যাতে বাধা না হন, তা নিশ্চিত করতে এই আনুগত্য জরুরি।

তৃণমূল-শাসনে এই হুমকি-প্রথাভিত্তিক খাজনা আদায়ের সংস্কৃতিটি সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী হয়েছে। তবে, বঙ্গভূমে এই প্রথার উৎপত্তিও তৃণমূল আমলেই ঘটেছে, এ কথা বললে সিপিএমের লোকাল কমিটির প্রেতাত্মাগুলিও অট্টহাস্য করে উঠবে। পার্টির ক্ষমতা ব্যবহার করে ভয় দেখানো, নাজেহাল করা, হুমকি দেওয়া, চাকরিক্ষেত্রে বিবিধ অসুবিধা তৈরি করা, এবং অতি অবশ্যই আনুগত্য ক্রয়— বাম আমলে এর প্রতিটি ঘটনা অতি নিয়মিত ঘটেছে। তৃণমূল আমলে এই অনাচারের তীব্রতা বেড়েছে। তার একটি বড় কারণ, এই জমানায় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তির গণতান্ত্রিকায়ন ঘটেছে— অর্থাৎ, শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত যে কেউ এখন অবৈধ খাজনা আদায়ের অধিকারী। খাজনার ক্ষেত্র— অর্থাৎ যে কোনও পরিসর, যেখানে সাধারণ মানুষ যে কোনও গোত্রের কাজ করে থাকেন— আয়তনে সীমিত, কিন্তু আদায়কারীর সংখ্যার কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। অর্থশাস্ত্রের যুক্তি বলবে, এমন ক্ষেত্রে অতি-শোষণ অনিবার্য— অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় যা ‘ট্র্যাজেডি অব দ্য কমন্স’ নামে খ্যাত। যে হারে শোষণ করলে ব্যবস্থাটি সুস্থায়ী হতে পারে, এই গোত্রের ‘কমন প্রপার্টি’-র ক্ষেত্রে শোষণের হারটি তার চেয়ে অনেক বেশি। এবং, শোষণের হার যত বাড়ে এবং শোষণযোগ্য সম্পদের পরিমাণ যত কমতে থাকে, খাজনা আদায়ের জন্য হুমকি ও বাহুবলের ব্যবহারও ততই অনিবার্য হয়ে পড়ে। যে ক্ষেত্রগুলি এত দিন খাজনা আদায়ের পরিসরের বাইরে থাকত, সেগুলিও তার অন্তর্গত হতে থাকে। অভিজ্ঞরা বলে থাকেন যে, বাম আমলে দুর্নীতিও চলত লোকাল-জ়োনাল-রাজ্য কমিটির নির্দিষ্ট ক্রমান্বয়ের নিয়ন্ত্রণে— ফলে, অতি-শোষণকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত। তবে, অতীতে কী হয়েছে, সে যুক্তি দিয়ে যে বর্তমানের অন্যায়কে কোনও ভাবেই সমর্থন করা চলে না, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন। এই সর্বগ্রাসী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের দায়ভারটি শেষ পর্যন্ত তাঁরই উপরে বর্তায়।

অন্য বিষয়গুলি:

RG Kar Medical College and Hospital Incident Threat Culture RG Kar Protest Work Space Political interference
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy