এই বাজেটে আক্ষরিক অর্থেই অন্য দিকে তাকালেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। অতিমারির সময় থেকে সরকার স্পষ্টতই জোর দিয়েছিল জোগানের দিকে— মনে করেছিল, উৎপাদনে বিভিন্ন প্রণোদনা দিলেই অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্য ফিরবে। এই বাজেট চাহিদা ফেরানোর পথে হাঁটল। তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে প্রভূত করছাড়ের ব্যবস্থা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই বাবদ কেন্দ্রের রাজস্ব ক্ষতি হবে মোট এক লক্ষ কোটি টাকা। গত কয়েক বছর দেশের মধ্যবিত্ত অংশটি যে বিপুল চাপে রয়েছে, তাতে এই কর ছাড়ের রাজনৈতিক সুফল প্রশ্নাতীত। তবে, অর্থমন্ত্রী শুধুমাত্র রাজনীতির কথাই ভেবেছেন, এমন অভিযোগ করা অনুচিত হবে। এই সিদ্ধান্তের পিছনে অর্থনৈতিক যুক্তিটি সরল— এই কর ছাড়ের ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড় অংশের হাতে মাসিক আয় আড়াই থেকে পাঁচ-ছ’হাজার টাকা অবধি বাড়বে। অনুমান যে, এই টাকাটির সিংহভাগ খরচ হবে ভোগব্যয়ে, কারণ এত দিন অবধি হাতে টাকার অভাবে তাঁরা অনেক চাহিদা পূরণ করতে পারছিলেন না। যেহেতু ভোগব্যয়েই ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’ সর্বাধিক, ফলে এই চাহিদাবৃদ্ধি জাতীয় আয়ের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটাবে। কেউ বলতেই পারেন, এর ফলে চাহিদা বাড়বে সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের— কারণ, ভারতে মাত্র সাত শতাংশ মানুষ আয়কর দাখিল করেন; তাঁদেরও একটি অংশমাত্র প্রকৃত আয়করদাতা। এখানেই ট্রিক্ল ডাউন এফেক্টের উপরে এই সরকারের অবিচলিত আস্থা স্পষ্ট— বাজেটের বিশ্বাস, এই অংশের মানুষের ভোগব্যয় বৃদ্ধি পেলে অর্থব্যবস্থায় যে গতির সঞ্চার হবে, তার সুফল চুইয়ে নামবে সমাজের বাকি অংশের কাছেও। সে বিশ্বাসের ক’আনা সত্য, তা সময়ই বলবে।
অন্য দিকে তাকানোর দ্বিতীয় উদাহরণটি রাজনৈতিক। ২০২৪ সালের লোকসভা ও একাধিক বিধানসভা নির্বাচনে স্পষ্ট যে, এক দিকে যেমন এনডিএ-র ছোট শরিকদের দিকে তাকাতে হবে, অন্য দিকে রাজ্য স্তরের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। এই বাজেটে বিহারের প্রতি প্রকট পক্ষপাতকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখা বিধেয়। বিজেপি সম্ভবত আঞ্চলিক দলগুলিকে এই বার্তা দিতে চায় যে, রাজনৈতিক ভাবে তাদের পাশে থাকলে রাজ্যগুলির প্রত্যক্ষ আর্থিক লাভ হবে। ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের যে কথা বিজেপি বলে থাকে, এটিকে তার পরিবর্ধিত রূপ হিসাবে দেখা যেতে পারে। অন্য দিকে, এ বছর নরেন্দ্র মোদী ৭৫ বছর পূর্ণ করবেন। তাঁরই নীতি অনুসারে তিনি তৎক্ষণাৎ সক্রিয় রাজনীতি ত্যাগ করে ‘মার্গদর্শক’ হবেন, এতখানি না ঘটলেও ২০২৯ সালের লোকসভা নির্বাচন মোদী-কেন্দ্রিক না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দলের আঞ্চলিক শক্তির গুরুত্ব বাড়বে। বিহারের প্রতি উদারহস্ত হওয়া এক অর্থে বিজেপির প্রাদেশিক রাজনীতির প্রতিও বার্তা— রাজ্য স্তরে শক্তিশালী হয়ে উঠলে কেন্দ্রও সাহায্য করতে পিছপা হবে না।
তবে, অর্থমন্ত্রী যে দিকগুলোর দিকে তাকালেন না, তার কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রথম উদাহরণ গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা। তার অর্থবরাদ্দ গত বছরের চেয়ে এক টাকাও বাড়েনি, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির অঙ্কটি বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দ কমল। আয়কর ছাড় যাঁদের জন্য অপ্রযোজ্য, এই বাজেট তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর কথা ভাবল না। এই মুহূর্তে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ভারতের সামনে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রীর বাজেট-ভাষণে সেই প্রসঙ্গ এল যৎসামান্য— এবং, সেই ভাবনায় সরকারের প্রত্যক্ষ কোনও কর্তব্য নেই, মূলত ট্রিক্ল ডাউন এফেক্ট-নির্ভর কর্মসংস্থানের কথা বললেন অর্থমন্ত্রী। অন্য দিকে, সুস্থ ও সবলতর ভারত গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও পিএম-পোষণ প্রকল্পে বরাদ্দ কমল। আয়করে বিপুল ছাড়ের ঘোষণার ‘ধামাকা’য় এই কথাগুলি চাপা পড়ে যাবে, এমন হিসাব কষেই কি ওই ঘোষণাটিকে একেবারে শেষ পাতে রাখা হল? সব ক্ষেত্রে শেষ ভাল হলেই সব ভাল নয়, কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)