Advertisement
E-Paper

অমানবিক, বেআইনি

প্রশ্ন হল, পুলিশ-প্রশাসনের কি শাস্তিবিধানের অধিকার আছে, না কি যাবতীয় প্রমাণসমেত অভিযুক্তকে আদালতের সামনে হাজির করাতেই পুলিশের দায়িত্ব সীমিত?

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০২৫ ০৬:৩৫
Share
Save

আদালতের তীব্র ভর্ৎসনায় নিজেদের অন্যায় বুঝবে উত্তরপ্রদেশ সরকার, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কত? মৌসিনরামে খরা হওয়ার সম্ভাবনা কি তার চেয়ে বেশি? এই প্রশ্নের উত্তর অনুমান করা চলে। কিন্তু, তার পরও, উত্তরপ্রদেশ সরকারের বুলডোজ়ার রাজ বিষয়ে শীর্ষ আদালতের রায় ভারতের রাজনৈতিক বাস্তুতন্ত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইলাহাবাদে যোগী সরকারের প্রশাসন ছ’টি পরিবারের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছিল— বলেছিল, বাড়িটি পুলিশি হেফাজতে থাকার সময়ই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংয়ের গুলিতে নিহত’ গুন্ডা থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠা আতিক আহমদের। বাড়িটি আসলে কিছু নিরপরাধ মানুষের— ধর্মে অবশ্য তাঁরা সকলেই মুসলমান। সেই মামলা শীর্ষ আদালতে পৌঁছয়। বিচারপতি অভয় এস ওকা ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভুঁইয়ার দুই সদস্যের বেঞ্চ তার রায়ে জানিয়েছে, ঘটনাটি ‘অমানবিক ও বেআইনি’; রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, প্রতিটি পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। (বুলডোজ়ার দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার) ঘটনাটি তাঁদের বিবেকবোধকে ধাক্কা দিয়েছে বলে জানিয়ে আদালত স্মরণ করিয়ে দেয়, এ দেশে মানুষের বাসস্থানের মৌলিক অধিকার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে ব্যবস্থা গ্রহণের আইনি পদ্ধতি, এবং সর্বোপরি, রয়েছে আইনের শাসন। প্রশাসনকে মনে রাখতেই হবে যে, বাসস্থানের অধিকার সংবিধানের ২১ ধারায় স্বীকৃত জীবনের অধিকারের অন্তর্গত। আদালতের এই কঠোর তিরস্কার থেকে উত্তরপ্রদেশ সরকার যদি বোঝে যে, দেশ এখনও ততখানি ‘রামরাজ্য’ হয়ে যায়নি যেখানে তারা যথেচ্ছাচার করে পার পাবে; অথবা মধ্যপ্রদেশ বা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যগুলিও যদি বোঝে যে, আদিত্যনাথ যতই পরবর্তী হিন্দু হৃদয়সম্রাট হয়ে উঠুন, তাঁর পথ পরিত্যাজ্য— তা হলে দেশের মঙ্গল।

প্রশ্ন হল, পুলিশ-প্রশাসনের কি শাস্তিবিধানের অধিকার আছে, না কি যাবতীয় প্রমাণসমেত অভিযুক্তকে আদালতের সামনে হাজির করাতেই পুলিশের দায়িত্ব সীমিত? নিরপরাধের বাড়ি তো কোনও মতেই গুঁড়িয়ে দেওয়া চলে না, কিন্তু দাগি অপরাধীর বাড়ির উপরেও কি বুলডোজ়ার চালাতে পারে প্রশাসন? এই কাজের জন্য নিয়মিত একটি অজুহাত খাড়া করে উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন— নির্দিষ্ট বাড়িটি অবৈধ ভাবে নির্মিত, অথবা অবৈধ জমিতে নির্মিত। সেই অজুহাতকে সত্য মেনে নিলেও প্রশ্ন, কোনও কারণেই কি কারও বাসস্থান কেড়ে নিতে পারে প্রশাসন? অন্তত, তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের যথেষ্ট সুযোগ না দিয়ে, বিকল্প বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারার আগেই? এই মামলায় আদালত প্রশ্নটি তুলেছে, এবং প্রশাসনের তরফে পদ্ধতিগত খামতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। নিতান্ত সর্বজনজ্ঞাত গোপন কথাটি হল, উত্তরপ্রদেশে, বা তার দেখাদেখি অন্য রাজ্যেও বুলডোজ়ার যাঁদের বাড়ির উপরে চলে, তাঁরা সকলেই মুসলমান। শাসকের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অস্ত্র হয়ে ওঠে প্রশাসন, ভারতীয় রাজনীতিতে এ কথাটির মধ্যে তিলমাত্র নতুনত্ব নেই— উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন যদি কিছুমাত্র বিশেষত্ব দাবি করতে পারে, তবে তা শাসকের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের প্রাবল্যে। এই বুলডোজ়ার-রাজের মধ্যে যে বিপুল অন্যায় নিহিত— এবং, আক্রমণের লক্ষ্য যে-হেতু দৃশ্যত ধর্ম দ্বারা নির্দিষ্ট, ফলে এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী শাসনের পক্ষপাতদুষ্টতাও স্পষ্ট— এ কথা বিরোধী রাজনীতি ও নাগরিক সমাজ বহু বার বলেছে। ভারতের দুর্ভাগ্য, বৃহত্তর জনসমাজে এই কথাগুলির অনুরণন ঘটেনি। সংখ্যালঘুর প্রতি নিপীড়নের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের এই সম্মতিই ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রধানতম ভিত্তি। তবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকও মনে রাখতে পারেন, স্বৈরতন্ত্রী শাসন শেষ অবধি কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না। আজ না হোক পরশুর পরের দিন বুলডোজ়ারের অভিমুখ আজকের সমর্থকদের দিকে ঘুরবে না, সে গ্যারান্টি নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই বিপদ থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ, এমনকি ‘ভক্ত’দের জন্যও।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bulldozer Uttar Pradesh

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}