দিল্লির ‘কর্তব্য পথ’-এ সুভাষ চন্দ্র বসুর নয়া মূর্তি।
পরিস্থিতি যেমন, তাতে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা ধার করে বলতে হয়: রাজনীতি এসে ইতিহাসকে নিয়ে গেল! গত বছর দুয়েক ধরে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি জুড়ে যে কর্মকাণ্ড চলছে, তাতে কেবল রাজনীতিই আছে— স্বার্থান্ধ, লোভাতুর রাজনীতি— ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও নেই। নেতাজিকে নিয়ে বাঙালির প্রভূত গর্ব, কিন্তু সেই গর্বকে মূলধন করে মিথ্যা রাজনীতির বেসাতির মধ্যে আছে এক বিরাট অন্যায়। গত ৮ তারিখে রাজধানী দিল্লির রাজপথে (যা এখন ‘কর্তব্যপথ’ নামক নব-অভিধায় সমুজ্জ্বল) নেতাজির বিশাল ২৮ ফুট মূর্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্মোচনের মধ্যে বর্তমান শাসকের সেই কূট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটিই জ্বলে উঠল। দুর্ভাগ্যজনক। বিপজ্জনকও। কী ভাবে সত্য ভুলিয়ে মিথ্যা প্রচারকে জনজীবনে স্থাপন করা হয়, এবং জনমানস কী ভাবে সেই মিথ্যার আবর্তে ঘুরতে ঘুরতে এক কল্পিত জগতের অংশীদার হয়ে যায়, ভারতবর্ষ আজ তা দেখছে। ইতিমধ্যে স্বার্থপ্রণোদিত বিজেপি রাজনীতি দ্বারা নেতাজির এই অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বা প্রবঞ্চনামূলক আত্মসাতের প্রতিবাদ করেছেন অনেকেই, যার মধ্যে আছেন নেতাজির ভ্রাতুষ্পৌত্র ইতিহাসবিদ ও প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সুগত বসুও। তবে সত্য-উত্তর বিশ্ব যে ভাবে বিকল্প বাস্তব তৈরি করে, তার জোর এতই বেশি যে তার সামনে কোথায় ভেসে যায় সতর্কবাণী কিংবা শুভবোধ, এমনকি ইতিহাসের তথ্যপ্রমাণও!
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই নরেন্দ্র মোদী নেতাজিকে ‘পুনরাবিষ্কার’ করেন। সম্ভবত দুটি কারণে তাঁকে সামনে নিয়ে এসে তিনি লাভবান হতে চান। প্রথমত, অনস্বীকার্য যে নেতাজি বাংলায় যতই বন্দিত হোন, অবশিষ্ট ভারতের মানসলোকে তাঁর উপস্থিতি খানিক প্রান্তিক। নেহরু পরিবারের ছত্রতলে কংগ্রেস চেষ্টা করে গিয়েছে নেতাজিকে গৌণ চরিত্র রূপেই দেখাবার। সুতরাং কংগ্রেসবিরোধিতার রাজনীতিতে তাঁর দাম অনেক। দ্বিতীয়ত, নেতাজির আইএনএ-কেও যোগ্য মর্যাদা দেয়নি স্বাধীন ভারতের সরকারি ইতিহাস। আজ়াদ হিন্দ ফৌজের আত্মত্যাগের বিবরণ অবাঙালিদের কাছে মোটের উপর অপরিচিত। ফলে প্রধানমন্ত্রী সহজেই নেতাজির ১২৫ বছর পূর্তি উৎসবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দাঁড়িয়ে নেতাজির সামরিক সংগঠন দক্ষতাকে নতুন করে প্রাধান্য দেওয়ার কথা তুলে ধরতে পারেন। বস্তুত এই শৌর্য-জাতীয়তাবাদ প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় ঘরানাও বটে। পরিকল্পিত ভাবে সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেসবিরোধী শক্তি হিসাবে, সামরিক নেতা হিসাবে, এমনকি ‘হিন্দু কুলতিলক’ হিসাবে নবপ্রতিষ্ঠা দিতে শুরু করেন। এর পিছনে কর্তৃত্ববাদী হিন্দুত্ব-সমীকরণটি স্পষ্ট, উজ্জ্বল।
অথচ এই সমীকরণের বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে তথ্যনিষ্ঠ ভাবে জানতে হলে নেতাজি বিষয়ে প্রধান তথ্যসমূহ দাঁড়ায়: এক, তাঁর সামরিক রাজনীতি ছিল এক দৃঢ় আদর্শে অন্বিত। বিদেশি শক্তির থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া, দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা শক্ত ভাবে প্রোথিত করা, প্রয়োজনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ সুরক্ষা দেওয়া, সমাজতন্ত্রের পথে দেশকে চালনা করা, কোনও সঙ্কীর্ণতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে দেশের বহুসংস্কৃতিকে প্রাণবান করে তোলার আদর্শ। উর্দু ভাষা তাঁর প্রিয় বলে আইএনএ-র স্লোগান ছিল ‘ইত্তেহাদ ইতমদ কুরবানি’। হিন্দু-মুসলিম একত্র খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। তাঁর অন্যতম প্রধান সেনানেতা ছিলেন মুসলমান। সঙ্কীর্ণ হিন্দুত্ববাদী নেতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল স্পষ্ট বিরোধ। গান্ধীজির পথ তিনি মানতেন না, কিন্তু সাভারকরের পথে ছিল তাঁর তীব্র বিদ্বেষ। কংগ্রেস সভাপতি হয়ে গোড়াতেই তিনি প্ল্যানিং কমিশনের কথা ভাবেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠালক্ষ্যে। এই নেতাজিকে হজম করা আজকের বিজেপি সরকারের কাজ নয়। তাই ইতিহাস ভুলিয়ে আজ কল্পকাহিনির নায়ক চরিত্র তৈরির দরকার হয়ে পড়েছে, তাঁর নামটির (অপ)ব্যবহার করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy