Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Dalai Lama

কথোপকথন

হিমাচলপ্রদেশের ধরমশালায় নির্বাসিত চতুর্দশ দলাই লামা তেনজ়িন গিয়াৎসো প্রায়শ বলেন, বৌদ্ধ ধর্মের আসল কথা হল প্রশ্ন তোলা, পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথন।

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০২৩ ০৭:৪৭
Share: Save:

নিউ ইয়র্কের গ্যারিসন ইনস্টিটিউট-এ সম্প্রতি ঘটে গেল ‘মাইন্ড অ্যান্ড লাইফ ইনস্টিটিউট’-এর সপ্তাহব্যাপী বৈঠক। দুই দশক ধরে বিভিন্ন দেশে বিজ্ঞানী, মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজকর্মীদের এই বৈঠক বসে আসছে। এ বারে তার অধিবেশনে হাজির ছিলেন হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক পিটার ওয়েন, ইজ়রায়েলের ইউনিভার্সিটি অব হাইফা’র মনস্তত্ত্বের অমিত বার্নস্টাইন, কলোরাডো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নাতালি আভালোস এবং আরও অনেকে। এই সব বিজ্ঞানী, ডাক্তার এবং নারী আন্দোলনের কর্মীদের পাশাপাশি ছিলেন কয়েক জন ইহুদি রাবাই, খ্রিস্টীয় যাজক ও বৌদ্ধ ভিক্ষু। এই বৈঠকগুলির লক্ষ্যই হল— ধর্ম এবং আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে কথোপকথন। দুই দিক থেকে শোনা, এবং মেলানোর চেষ্টা— এই যুদ্ধরত, হিংসা-আক্রান্ত, বৈষম্যব্যস্ত পৃথিবীতে কী ভাবে আনা যায় মানুষে-মানুষে সহমর্মিতা। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে সব মানুষ সমান, বা আধুনিক ‘সেকুলার’ বচনে এক প্রজাতির ‘হোমো সেপিয়েন্স’ আওড়ে তো বিশ্বযুদ্ধ, হিন্দুস্থান-পাকিস্তান বা ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বৈরথের হাত থেকে নিস্তার মেলে না। হিমাচলপ্রদেশের ধরমশালায় নির্বাসিত চতুর্দশ দলাই লামা তেনজ়িন গিয়াৎসো প্রায়শ বলেন, বৌদ্ধ ধর্মের আসল কথা হল প্রশ্ন তোলা, পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথন। এই পৃথিবীতে বৌদ্ধ ধর্ম যদি বিজ্ঞানের সঙ্গে সংলাপ চালাতে না পারে, সবই প্রাচীন বৌদ্ধ দর্শনে আছে বলে চোঁয়া ঢেকুর তোলে, তার মৃত্যু আসন্ন।

বস্তুত, দলাই লামাই এই বৈঠকের প্রাণপুরুষ। ১৯৮৭ সালে ধরমশালায় এই বৈঠক শুরু হয়, তার পর ঘুরিয়েফিরিয়ে নানা জায়গায়। অতঃপর ১৯৮৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হওয়ার পরে সেই অর্থমূল্যের পুরোটাই যায় বিভিন্ন খাতে বৃত্তি প্রদানে এবং বিজ্ঞান ও বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যে কথোপকথন চালানোর এই বৈঠকে। স্নায়বিক বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান কী না থাকে। এক বার পরিবেশ আন্দোলনের গ্রেটা থুনবার্গও উপস্থিত ছিলেন। তিব্বত একদা লামাদের ধর্মতন্ত্রে শাসিত হত ঠিকই, কিন্তু বর্তমান দলাই লামার নেতৃত্বে নির্বাসিত তিব্বতি জনতা গণতন্ত্র ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী। গত বছর এই বৈঠক বসেছিল ধরমশালায়, সেখানে এক প্রশ্নের উত্তরে দলাই লামা বলেছিলেন, গণতন্ত্রই তাঁর কাছে সবচেয়ে পছন্দের। সাংবাদিকরা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, দুনিয়ার অনেক দেশই এখন গণতন্ত্রের নাম করে একনায়কতন্ত্র বেছে নিয়েছে। দলাই লামা হেসে বলেছিলেন, কিন্তু সেই একনায়করাও বিশ্ব উষ্ণায়ন, যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ, মেয়েদের প্রতি হিংসা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখাতে পারেন না। বৌদ্ধ ভিক্ষুর বক্তব্য, অন্য মানুষ বা প্রাণীর প্রতি সমানুভূতি নিছক ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বজনীন দায়িত্ব। ‘সমানুভূতি’ শব্দটা অন্য রকম। অন্যের কষ্ট সমান ভাবে অনুভব করার ক্ষমতা। এক বার বৈঠকে ধর্মীয় প্রতিনিধিদের বক্তব্য ছিল, ধর্মীয় শিক্ষা বাড়লেই লোকে অন্যের প্রতি দরদি হবে। দলাই লামা কিন্তু উল্টো কথা বললেন, যুক্তিবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বাড়লেই সমানুভূতি বাড়বে। সবাই বললেন, কিন্তু সেখান থেকেই যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ ও হিংসার জন্ম। দলাইয়ের যুক্তি, ইতিহাস অন্য কথা বলে। কয়েক হাজার বছরের মানব-ইতিহাসে গড়ার কথাই বেশি, ভাঙার কথা কম। বেশির ভাগ মানুষ অন্যের প্রতি মমত্ব বোধ করে, সেই কারণে হিংসার খবরে তারা দুঃখ পায়। আর বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম আর্যসত্য, দুঃখনিবৃত্তির উপায় আছে!

একেই ভারতীয় ঐতিহ্য বলে মনে করেন যাঁরা, তার মধ্যে পড়েন দলাই লামাও। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের ধারণা তিনি পেয়েছেন নেহরুর থেকে। শরণার্থী হিসাবে ভারতে আসার পর নেহরুই তাঁকে বলেছিলেন, বৌদ্ধ মঠের স্কুলেও ইংরেজি ভাষা এবং বিজ্ঞানশিক্ষার ব্যবস্থা করতে। সেই সুফলই এখনকার নির্বাসিত তিব্বতি প্রজন্ম পাচ্ছেন। প্রাচীন ভারতে গণরাজ্য ছিল বলেই ভারতকে গণতন্ত্রের ধাত্রীভূমি বলা যায় না। মগধের রাজা অজাতশত্রু বজ্জি গণরাজ্য আক্রমণ করতে গেলে শাক্যমুনি তাঁকে কতকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল, বজ্জিরা বারংবার সভা ডেকে একত্র হয় কি? যে আইন নিজেরা করেনি, সেই আইন নিজেদের বলে চালায় না তো? দেশের বৃদ্ধ রাজনীতিবিদদের তারা সম্মান করে তো? মেয়েদের উপর অত্যাচার করে না তো? সবেরই উত্তর যখন এল হ্যাঁ, গোতম জানালেন, এই নিয়মগুলি মানলে বজ্জিদের কোনও ক্ষতি করা যাবে না। ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত মূলটি সব ‘প্রাচীন’ রাজ্যে ছিল না, কিছু কিছু রাজ্যে ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম সেখানে পালন করেছিল এক বড় ভূমিকা।

অন্য বিষয়গুলি:

Dalai Lama Science Buddhism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy