E-Paper

ধুলায় হয়েছে ধূলি

ছাত্রছাত্রীদের লেখার অভ্যাস ভয়ানক ভাবে নষ্ট হচ্ছে। এবং তার একটি বড় কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রবল প্রভাব।

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৮:২৯
Share
Save

গত শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটেনে ইংরেজি ভাষার এক প্রসিদ্ধ গদ্যকার একটি সভায় বক্তৃতা দেওয়ার পরে চায়ের আসরে এক অতিথি তাঁকে বলেছিলেন: আপনার বক্তৃতা ভাল, তবে আপনার লেখা আরও অনেক ভাল। তিনি হেসে জবাব দিয়েছিলেন: আসলে লেখার পিছনে যত সময় দিই, লেখা ভাল করার জন্য যত পরিশ্রম করি, বলার জন্য তো তা করি না, করলে হয়তো আর একটু ভাল বলতে পারতাম। কথাটি মূল্যবান। অনেক কাজের মতোই লেখার কাজটিও অনুশীলন দাবি করে। করারই কথা। ভাষা ভাব প্রকাশের বাহন, সুতরাং তাকে যথাযথ চালনার জন্য দক্ষতা আবশ্যক; সেই দক্ষতা আকাশ থেকে পড়ে না, তা অর্জন করতে হয়। সুলেখক হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ‘সহজাত’ বা ‘স্বাভাবিক’ স্বাচ্ছন্দ্যের গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু দু’টি বিষয়ে সতর্ক না হলে স্বাভাবিকতাকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। প্রথমত ‘স্বভাব’ স্বয়ম্ভু নয়, তার পিছনেও অনুশীলনের ভূমিকা অনস্বীকার্য— প্রথম সারির লেখকদের অধিকাংশের জীবনবৃত্তান্তে উঁকি দিলেই দেখা যাবে, লেখার কাজটিতে তাঁরা কতখানি পরিশ্রমী ছিলেন। দ্বিতীয়ত, যার যে স্বাভাবিক সামর্থ্যই থাকুক, তাকে প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করে তোলার জন্য পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই।

এই সত্যটিই অন্য ভাবে— বিপরীত দিক থেকে— প্রকট হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় যে অনুশীলনের অভাবে বা ভুল অনুশীলনের পরিণামে কী ভাবে সুলেখকের বদলে কুলেখক তৈরি হতে পারে। এক জন দু’জন নয়, বর্ষে বর্ষে দলে দলে। সম্প্রতি কলকাতার একাধিক স্কুলের বেশ কয়েক জন অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল শিক্ষকের কথায় এই সমস্যার রূপ ধরা পড়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের লেখার অভ্যাস ভয়ানক ভাবে নষ্ট হচ্ছে। এবং তার একটি বড় কারণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রবল প্রভাব। স্কুলের পড়াশোনার বাইরে, অংশত তার মধ্যেও, পড়া এবং লেখা বলতে যা কিছু তার প্রায় সবটাই এখন মোবাইল-বাহিত। তাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ কার্যত ষোলো আনাই নানা ধরনের সংক্ষিপ্ত বার্তা লেনদেনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়ে চলে। কোনও বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে বিশদ ভাবে কিছু লেখা বা পড়ার অবকাশ নেই, প্রয়োজনও নেই, সবাই অতি দ্রুত সওয়াল-জবাব চালাতে আগ্রহী, কথোপকথন হয়ে দাঁড়িয়েছে টেবিল টেনিসের অনুরূপ। সমাজমাধ্যমের যে পরিসরগুলি অল্পবয়সিদের পছন্দসই, সেখানে ‘গুছিয়ে লেখা’র কোনও প্রশ্নই ওঠে না। শিক্ষকরা জানাচ্ছেন, এই অভ্যাসের সুস্পষ্ট ছাপ পড়ছে শিক্ষার্থীদের লেখায়। যারা ‘ভাল ছাত্রছাত্রী’ বলে পরিচিত ও প্রশংসিত তাদেরও একটি বড় অংশ সুচারু ও সুশৃঙ্খল ভাবে কোনও লেখা লিখতে পারে না, এমনকি আনুষ্ঠানিক বা পোশাকি চিঠিপত্র অবধি লেখার দক্ষতাও তাদের অনায়ত্ত। লেখা তাদের কাছে সচরাচর একটি দায়সারা কাজমাত্র, কোনও ক্রমে সেই দায় সেরে ফেলেই তারা সন্তুষ্ট।

বলা বাহুল্য, এই সমস্যা ওই কয়েকটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নয়, দুনিয়া জুড়ে সমস্ত বয়সের নাগরিকদের মধ্যেই তার প্রকোপ ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তবে সঙ্গত কারণেই অল্পবয়সিদের নিয়ে উদ্বেগ সর্বাধিক, বিভিন্ন দেশেই শিক্ষাবিদরা সেই উদ্বেগ জানিয়ে চলেছেন। ডিজিটাল মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার এই সমস্যার একটি বড় কারণ, তবে তার পাশাপাশি বিদ্যাচর্চার গোটা ব্যবস্থাটির দায়ও কম নয়। কোনও বিষয়ে সুষ্ঠু ধারণা অর্জন করা এবং যুক্তি সহকারে চিন্তা করতে শেখা— শিক্ষার এই প্রাথমিক লক্ষ্যগুলিই অধুনা দূর থেকে আরও দূরে বিলীয়মান। বাঁধাধরা পাঠ্যসূচি এবং তার ভিত্তিতে প্রদত্ত ক্লাস-নোট গলাধঃকরণ করে ‘এক কথায়, প্রায়শই ‘এক শব্দে’, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার রীতি বহুলপ্রচলিত, যা উত্তরোত্তর পর্যবসিত হচ্ছে একাধিক সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে থেকে ঠিক উত্তর বেছে নেওয়ার পরীক্ষায়। এই পদ্ধতি সুশৃঙ্খল চিন্তা ও যুক্তিপ্রয়োগে সাহায্য করা দূরে থাকুক, তার সমস্ত সামর্থ্য ধ্বংস করে চলে। তার ফলে দেখা যায়, বহু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে, কিন্তু অধীত বিষয়ে অথবা চার পাশের জগৎ ও জীবন নিয়ে সাধারণ ধারণার ভিত্তিতে গুছিয়ে কথা বলতে বা লিখতে অপারগ। অর্থাৎ, ব্যাধি শিক্ষার মূলে। সচেতন শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমবেত উদ্যোগ ছাড়া নিরাময়ের আশা নেই। এ দেশে, বিশেষত এই রাজ্যে, সেই উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই, কারণ সরকারি নীতিকার তথা রাজনীতির নায়কনায়িকারা এই সব বিষয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন। নাগরিকদের সুশৃঙ্খল চিন্তাভাবনার অভ্যাস না থাকলেই বোধ করি তাঁদের পোয়া বারো।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Practice Writing Habit Students

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।