এবার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকায় কতটা দুধ আর কতটা জল, তার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের এক পঞ্চায়েত সদস্যের চারতলা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম মিলেছে তালিকায়। অবশ্য তাতে আজ কে-ই বা আশ্চর্য হয়? পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে, ব্লকে ব্লকে এমন নেতারা ছড়িয়ে রয়েছেন। বার বার অভিযোগ উঠেছে, শাসক দলের নেতারা দরিদ্রকে বঞ্চনা করে সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করছেন, মার্বেল-খচিত বাড়ি থেকে দুয়ারে মোটরসাইকেল তাঁদের ক্ষমতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। অতি অল্প সময়ে নেতাদের বিপুল ধনবান হয়ে ওঠা দেখতে রাজ্যবাসী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অতএব এই অনুসন্ধান নেহাতই নিয়মরক্ষা, কেন্দ্রের চোখরাঙানিতে রাজ্য বাধ্য হয়ে ঘাড় কাত করেছে। প্রকল্পের টাকা আটকে যাওয়া বড় ফ্যাসাদ। এর আগে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে দুর্নীতির অনুসন্ধান করে ‘অ্যাকশন টেকেন’ রিপোর্ট দিয়েছিল রাজ্য। তদন্ত করে সামান্য কিছু গরমিল কেবল পেয়েছিলেন রাজ্যের কর্তারা। রাজ্যব্যাপী ‘পুকুরচুরি’-র যে ছবি বার বার উঠে এসেছে সংবাদে, তার কোনও প্রতিফলনই দেখা যায়নি সেপ্টেম্বরে জমা-পড়া সেই রিপোর্টে। কেন্দ্র তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে, নভেম্বরে ফের নানা প্রশ্নের উত্তর দাবি করেছে। এ বার আবাস যোজনায় যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে, তাতেই বা প্রকৃত চিত্র কতখানি উঠে আসবে? সংশয় আরও গাঢ় হয় এই সংবাদে যে, গ্রামে অনুসন্ধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের হুমকি, দুর্ব্যবহারের মুখে পড়তে হয়েছে। অনেকে কাজ স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছেন।
রাজকোষের টাকার ব্যয়ে স্বচ্ছতা রক্ষা করার গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু এ রাজ্যে তা যেন ক্রমশ প্রহসনে পর্যবসিত হচ্ছে। দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ প্রবল হলেই গুটিকতক নেতা অথবা সরকারি আধিকারিকের উপর তার দায় চাপিয়ে, তাঁদের প্রকাশ্যে হেনস্থা করে বা শাস্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন শীর্ষ নেতারা। হয়তো আশা করছেন, এর ফলে জনমানসে তাঁদের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের নেতাদের ‘কাটমানি’ ফেরত দেওয়ার হুঁশিয়ারি থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পূর্ব মেদিনীপুরের মারিশদা পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান, উপপ্রধান ও অঞ্চল সভাপতির পদত্যাগ, এ সব ঘটনাই এই দূরত্ব রচনার দৃষ্টান্ত। কিন্তু রাজনীতি ও প্রশাসনের নিরিখে এই চেষ্টা হাস্যকর। নেতা নিজে দুর্নীতিমুক্ত কি না, তার থেকেও বড় প্রশ্ন, তিনি দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছেন কি না। পাঁচ-দশ বছর যে পঞ্চায়েত প্রধান অথবা বিধায়ক, মন্ত্রী রীতিমতো অবাধে দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁকে বহিষ্কার করে, জেলে পাঠিয়ে লাভ কী?
উন্নয়নের প্রকল্পের দুর্নীতি কেবল টাকার অঙ্কে মাপা যায় না। টাকার অভাবে যে কাজ হয়নি— খাদ্যাভাবে শিশুর অপুষ্টি, সেচের অভাবে নষ্ট ফসল, রাস্তার অভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির অপ্রসার— তার ক্ষতি আরও অনেক ব্যাপক। নেতাদের এক-একটি তিনতলা বা চারতলা বাড়ির তলায় চাপা পড়েছে কয়েকশো গৃহহীনের উন্নত জীবনের সম্ভাবনা। আবাস যোজনা, একশো দিনের কাজ, ত্রাণ বিতরণ থেকে চাষির ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি, সর্বত্র ক্ষমতাসীনের দুর্নীতি রাজনীতির এক গভীরতর সঙ্কটকে নির্দেশ করে। তা হল, গ্রামবাসীর সঙ্গে নেতাদের বিচ্ছিন্নতা। গ্রামসভা ডেকে সকলের সম্মতিক্রমে সরকারি প্রকল্পের সুবিধার প্রাপক তালিকা পাশ করানো নিয়ম। এতে অস্বচ্ছতার সুযোগই নেই। কিন্তু প্রাপ্য-বঞ্চিতদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হবে বলে আজ গ্রামসভা ডাকার সাহস নেই শাসক দলের বহু নেতার। এ ভাবেই নির্বাচনে হিংসা অনিবার্য হয়ে ওঠে, এবং রাজকোষের অপচয়ও অবধারিত হয়ে দেখা দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy