Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Sonali Chakravarti Banerjee

দর্পহরণ

এই ঘটনা থেকে একটা বড় শিক্ষা নেওয়ার আছে বইকি। পদ্ধতি বস্তুটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সম্ভবত বর্তমান ভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গে, বিস্মৃত হতে বসেছে।

সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২২ ০৬:১০
Share: Save:

অতি উচ্চাশায় হতা লঙ্কা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এই একটিই কথা বলার থেকে যায়। রাজ্য সরকার ঠিক কী ভাবছিল কে জানে, কিন্তু এত দ্রুত এত বড় পরিবর্তন সাধন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের দখল সম্পূর্ণ করার এই দুর্বুদ্ধিজাত তাড়না— এর ফল যে ভাল হতে পারে না, তা অনেক আগেই বোঝার কথা ছিল। বিবেচনাহীন পদক্ষেপ করলে যা ঘটার, তেমনই ঘটল। সর্বোচ্চ আদালত যে কেবল নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগের এ-হেন পদ্ধতিকে অনিয়মিত ও অবৈধ বলে রায় দিল, তা-ই নয়, তীব্র ভর্ৎসনার স্বর ধ্বনিত হল তার বক্তব্যে। গোটা ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চরম লজ্জা বোধ করার কথা। আচার্যের ক্ষমতা ছাঁটার রাজনৈতিক তাগিদ তাঁদের থাকতেই পারে, সেটা অসঙ্গত নয়, অবোধ্যও নয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে বর্তমান আইনবিধি দ্রুত পাল্টে ফেলে, তাকে লঙ্ঘন করে, ভুল যুক্তি দর্শিয়ে উদ্দেশ্য সাধনের যে বিকৃত পন্থা তাঁরা ব্যবহার করলেন, তা অতিশয় উদ্বেগজনক। উদ্বেগটি রাজ্য প্রশাসনের নিয়ম-বহির্ভূত কাজ করার প্রবণতাটি নিয়ে। রাজনৈতিক বিরোধিতা যতই গুরুতর হোক, আচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগও যত গভীরই হোক, আইন-মোতাবেক যে নিয়ম মেনে এত কাল নিয়োগ ও পুনর্নিয়োগ হয়ে এসেছে, তাকে বদলাতে হলে পদ্ধতি-অনুসারী পদক্ষেপই করতে হবে, পদ্ধতির পাশ কাটিয়ে শর্টকাট করে যদৃচ্ছ পা ফেলা যাবে না— এই সামান্য সত্যটি কি তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন? না কি, চমকদারি যুক্তি দেখিয়ে আদালতে কোনও মতে পার পেয়ে যাবেন বলে আশা বুনেছিলেন?

সমগ্র সঙ্কটটি অবশ্যই শুরু হয়েছিল পূর্বতন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের জায়গায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং/সুতরাং রাজ্য সরকারের বিরোধী পক্ষ হিসাবে অবতীর্ণ হতে শুরু করেছিলেন। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক: বহু সতর্কবাণী সত্ত্বেও তিনি আত্মসংশোধনের কোনও লক্ষণ দেখাননি। কেবল রাজ্য সরকার কেন, নিরপেক্ষ নাগরিকেরও বিরক্তি উৎপাদনের বিস্তর কারণ ঘটেছিল সেই সময়ে। কিন্তু সেই ঘটনার অভিঘাতে রাজ্যপাল তথা আচার্যকে নিষ্ক্রিয় করতে যে ভাবে অগ্রসর হয়েছিল তৃণমূল সরকার, সঙ্কট শুরু হল সেখানেও। ‘রিমুভাল অব ডিফিকাল্টিজ়’ ধারাটি যে ভাবে তড়িঘড়ি সরানো হল, তাতে আইনগত অনাচার তৈরি হল, এবং পর পর হাই কোর্টে ও সুপ্রিম কোর্টে তা অবৈধ প্রতিপন্ন হল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গোটা দেশের মধ্যে প্রাচীনতম ও সম্ভবত এখনও, প্রখ্যাততম কতিপয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি। সেখানে কুদৃষ্টান্ত স্থাপন কেবল সরকারের মুখে কালি ফেলল না, সমগ্র রাজ্যের পক্ষেই কলঙ্ক হয়ে দাঁড়াল।

এই ঘটনা থেকে একটা বড় শিক্ষা নেওয়ার আছে বইকি। পদ্ধতি বস্তুটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সম্ভবত বর্তমান ভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গে, বিস্মৃত হতে বসেছে। উপযুক্ত পদ্ধতি-অনুসারী না হওয়ার ফলে সঙ্গত সংশোধনও করা যায় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রথা বা আইনের পাশ কাটিয়ে কিংবা তাকে অগ্রাহ্য করে চলার যে প্রবণতা আপাতত এ রাজ্যে সর্বত্র বিরাজমান— কৃষি, একশো দিনের কাজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা— সব ক্ষেত্রেই তা রাজ্যবাসীকে একটা সঙ্কট-পরিস্থিতিতে এনে ফেলছে। বিষয়টি গুরুতর। আইনি পথে চলা এবং প্রয়োজনে বৈধ পথে আইন সংশোধনে অগ্রসর হওয়া— এর কোনও বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। গায়ের জোরে বিকল্প তৈরি করে নেব, এমন যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা ভুল করছেন। এই ভাবনা বিপজ্জনক তো বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে বুমেরাংও, দেখাই যাচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy