সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা সমাজমাধ্যম এবং ডিজিটাল মাধ্যমের আচরণে বিচলিত। তাঁর বক্তব্য: বিভিন্ন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল পরিসরে বিচারকদের সম্পর্কে যে ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে, বিশেষত যে ভাবে ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অন্যায় দোষারোপ করা হচ্ছে, তার ফলে তাঁদের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ছে, আইন এবং জনমত, এই দুইয়ের টানাপড়েনে বিচারপতিরা বিব্রত হচ্ছেন, এটা বিচারবিভাগের মর্যাদার প্রতিকূল, বিচারপ্রক্রিয়ার পক্ষেও ক্ষতিকর। গণতন্ত্রে আইনের শাসন মানতেই হবে, আদালতের কথা শুনতেই হবে, জনমতের ধুয়ো তুলে এই মৌলিক শর্ত লঙ্ঘন করলে গণতন্ত্রের ভিতটাই বিপন্ন হয়ে পড়ে। বিচারপতি পারদিওয়ালা এতটাই ক্ষুব্ধ এবং উদ্বিগ্ন যে, এই সমস্যার মোকাবিলায় সংসদকে প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক বন্দোবস্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন, সমাজমাধ্যম এবং ডিজিটাল মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কী করা যায় তা নিয়ে ভাবতে বলেছেন।
এই ক্ষোভ এবং উদ্বেগ অহেতুক নয়। কোনও বিচারপতির বিচার পছন্দ না হলে তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, তাঁর সম্পর্কে আপত্তিকর বা কুরুচিপূর্ণ অভিযোগ আনা, এমনকি হুমকি দেওয়ার ঘটনা কোনও কালেই বিরল ছিল না, গল্প-উপন্যাসেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু অধুনা সমস্যাটি এক স্বতন্ত্র এবং অভূতপূর্ব মাত্রা অর্জন করেছে। তার নানা কারণ আছে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রবল বিস্ফোরণ একটা বড় কারণ। কিন্তু প্রযুক্তির বিস্ফোরণ যে সেই সমস্যাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। যে কোনও বিষয়ে অসন্তোষ বা আপত্তির কারণ ঘটলে এখন প্রায়শই ডিজিটাল পরিসরে যে ভাবে তার প্রকাশ ঘটে, যুক্তি ও তথ্যের তোয়াক্কা না করে এবং স্বাভাবিক সংযম, শৃঙ্খলা, এমনকি ন্যূনতম শোভনতার সীমা ছাড়িয়ে যে ভাবে আক্রমণ শাণানো হয় এবং মুহূর্তের মধ্যে চতুর্দিকে তার তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে, তা অনিবার্য ভাবে গণপিটুনির কথা মনে পড়িয়ে দেয়। বিচারপতিরাও ক্ষেত্রবিশেষে এই ডিজিটাল গণরোষের শিকার। তাঁরা অবশ্যই জানেন যে, এই সব কটূক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাই তাঁদের কাজ, আইনের দেবীর মতো কেবল চোখ নয়, তাঁদের কানও বন্ধ রাখা বিধেয়। কিন্তু পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে স্বধর্মে সুস্থিত থাকা কঠিন হয় বইকি।
এই সমস্যার প্রতিকার কী? বিচারপতি পারদিওয়ালা সংসদকে রক্ষাকবচ নিয়ে ভাবতে বলেছেন। বিচারপতির সুচেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলতেই হয় যে, এই প্রস্তাব বিশেষ ভরসা দেয় না, বরং কিঞ্চিৎ আশঙ্কা জাগায়। ডিজিটাল পরিসরে এই ধরনের অন্যায় আক্রমণ যারা করে, তাদের একটা বিরাট অংশই ক্ষমতাবানদের আশ্রিত বা তাঁদের প্রতিনিধি। ভারতীয় সংসদের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি দেখে আদৌ ভরসা হয় না যে, সেখানে ক্ষমতার অধীশ্বরদের বাহিনীকে সংযত করবার কোনও সুবন্দোবস্ত হতে পারে। অন্য দিকে, শাসক বিরোধী নির্বিশেষে এ দেশের রাজনীতিকরা সংবাদমাধ্যম তথা জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা ও মতামতকে দমন করতে সতত আগ্রহী; তাই আশঙ্কা হয়, প্রচারমাধ্যমের অন্যায় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে তার স্বাধীনতা আরও খর্ব করা হবে না তো? সেটা কিন্তু হবে নোংরা জলের সঙ্গে শিশুটিকেও বিসর্জন দেওয়ার শামিল। বিচারপতি নিশ্চয়ই তেমনটা চাননি, তিনি গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, কিন্তু সদিচ্ছার পরিণাম অনেক সময়েই সুখের হয় না। বরং আইনের কেতাবে যে রক্ষাকবচ এখনই আছে, তা যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করা হোক। প্রয়োগ করা হোক সমস্ত অন্যায়কারীর বিরুদ্ধেই। দ্রুত, নিরপেক্ষ এবং কঠোর সুবিচারই আদালত তথা বিচারপতিদের মর্যাদার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy