Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
soma das

অ(ন)নুকরণীয়

প্রতি দিনের সংবাদ প্রমাণ, সভ্যতা-ভব্যতার জগৎ থেকে কী ভাবে দ্রুত ঘূর্ণিপাকে ছিটকে দূরে, অতি দূরে, সরে যাচ্ছে বাঙালি।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২ ০৮:৪৪
Share: Save:

কথায় কথায় আমরা বলে থাকি, এক হতে হবে। ঐক্য বন্ধনে মন দিতে হবে। জোট বেঁধে কাজ করতে হবে। এই যে ‘এক হওয়ার’ লব্জ, এর মধ্যে আসলে কী লুকিয়ে আছে, ভেবে দেখি কি আমরা? কী করে ‘এক’ বোধ করতে হয়, নিজের মধ্যেও আমরা কখনও অনুভব করি কি? করি না যে, সেটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন সোমা দাস। অসুস্থ তরুণী, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি রোধ আন্দোলনের কর্মী তিনি— সামান্য একটি বাক্যে অসামান্য এক বোধের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন। বললেন, ‘শুধু আমার নয়, চাকরি চাই পথে নামা সকলের’। যে আন্দোলনে তিনি নেমেছেন, তা কেবল তাঁর একার একটি চাকরি লাভের উদ্দেশ্যে ছিল না— সেই লড়াইয়ের লক্ষ্য ছিল সকলের জন্য ন্যায়বিচার। সকলকে চাকরি দিতে আদালত অপারগ বলে জানানোর পর তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে তাঁরও চাই না কোনও সুবিধার ‘উপহার’। অত্যন্ত সঙ্গত কথা— এই আন্দোলন কোনও ব্যক্তিগত সঙ্কটের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি, গোটা ব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনাচারের পচনের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছিল। অনেকে মিলে ‘একটি’ তলে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। বড় উদ্দেশ্যটা ভুলে নিজের ছোট স্বার্থটাকে জায়গা না দেওয়ার এই যে শান্ত কিন্তু দৃঢ় অবস্থান— আজ নতুন বছরের সকালে সমগ্র বাঙালি সমাজ এই একটি মেয়ের জন্য গৌরবান্বিত বোধ করতে পারে। এই স্বার্থান্ধ সময়ে এমন এক স্বার্থ-অতিক্রমী কথা ভাবতে পারলেন এই তরুণী, সকলের সামনে আদালতের ‘উপহার’ ফিরিয়ে দিতে পারলেন, সকলের লড়াইকে ব্যক্তিগত জয় দিয়ে মলিন ও ক্ষুদ্র করে দিলেন না। এমনকি বড় বড় রাজনৈতিক নেতারাও এই তরুণীর কাছে শিখতে পারেন, আন্দোলনকারীর নৈতিকতার পাঠ।

প্রতি দিনের সংবাদ প্রমাণ, সভ্যতা-ভব্যতার জগৎ থেকে কী ভাবে দ্রুত ঘূর্ণিপাকে ছিটকে দূরে, অতি দূরে, সরে যাচ্ছে বাঙালি। কী ভাবে কুকথা আর কদাচারের নিত্যনতুন উদাহরণ তৈরি করছেন অগ্রগণ্যরাও। নতমস্তক দিশাহারা এই সমাজে যে সোমা দাসেরাও আছেন, হয়তো থাকবেন, নববর্ষের আশা হিসাবে এইটুকুই আপাতত আঁকড়ে ধরার মতো সম্বল। কিন্তু এই সম্বলটুকু যদি কেবল ব্যক্তিগত ব্যতিক্রম হিসাবেই থেকে যায়, তা হলে আমরা সামাজিক ভাবে কোথাও পৌঁছতে পারব না, মাঝে মাঝে ব্যতিক্রমের বন্দনা গেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। তাই সোমা দাসের অনন্য নজিরটিকে যথার্থ মূল্য দিতে হলে আমাদের কর্তব্য একটা সত্যকার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, যা ব্যক্তি-মানুষকে সহনাগরিকদের সঙ্গে মানবিক সংযোগে সংযুক্ত করবে, সামাজিক ভাবে ভাবতে শেখাবে। কোনও সন্দেহ নেই যে সেই কাজ অতি কঠিন। কঠিন কেবল এই কারণে নয় যে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নিজের জন্য ভাবতে চায়, নিজের স্বার্থ দেখতে চায়, অপরের ভাবনা তার মনে স্বভাবত স্থান পায় না। সেটা একটা কারণ বটে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় সমস্যা হল, আমাদের অর্থনীতি এবং রাজনীতি দুইই এই চূড়ান্ত স্বার্থপরতাকে এক অ-পূর্ব মাত্রা দিয়েছে, যার তাড়নায় একেবারে মৌলিক মানবিকতার শর্ত লঙ্ঘন করতেও বহু মানুষের আজ আর একটুও বাধছে না। এই সমাজে সোমা দাসের দৃষ্টান্ত একেবারেই অননুকরণীয় বলে মনে হয়। এবং ঠিক সেই কারণেই তা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অন্য বিষয়গুলি:

soma das SSC
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE