সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। চলছে কি? দুর্গাপুজো সমাগত হলে বাঙালি বিশ্বের আকাশে-বাতাসে একটা নস্টালজিয়ার সুর ঘুরতে থাকে, এবং তার সঙ্গে ঘোরে একটি কালসংযুক্তির আবেগ ও আবেশ, যেন বাঙালি-উৎসবকে একই ভাবে সংরক্ষণ করা হয়ে চলেছে। বাস্তবিক, যে কোনও ধর্মীয় উৎসবেই এই কালসংযুক্তির ভাবটি বিধৃত থাকে, কেননা উৎসবের মূল ধর্ম-কেন্দ্রটির বিশেষ নড়চড় হয় না— পুজোর বাদ্য, পুজোর ধূপধুনো, পুজোর মন্ত্র, পুজোর ফুলের সঙ্গে একটি অপরিবর্তনীয়তার আভাস মিশে থাকে। কিন্তু এরই সঙ্গে আড়াল দিয়ে লুকিয়ে আসে পরিবর্তন। বাঙালি হয়তো খেয়ালও করে না যে অনবধানেই কতখানি পাল্টে গিয়েছে পুজোর সংস্কৃতি। এ কেবল পুজোর বাইরের অঙ্গসজ্জার কথা নয়, পুজো বলতে অন্তরে ও অন্দরে বাঙালি কী বুঝত আগে, আর কী বোঝে এখন, তার কথা। এ নিয়ে একটা সমাজতাত্ত্বিক চর্চা হতে পারে, যে চর্চা গুরুত্বপূর্ণ কেননা পুজোর এই পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আধুনিক সময়ের সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত জীবনের মোড়-ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনাবলি। এ যেন এক বড় ইতিহাসকে ছোট দর্পণে ধরার মতো। পঁচাত্তর বা পঞ্চাশ বছরে বাঙালি-বিশ্ব কেমন ভাবে পাল্টেছে, তার অবধারিত প্রতিফলন দেখা যেতে পারে পুজোর মধ্যেই।
যেমন, এক দীর্ঘ সময় ধরে পুজো ছিল বাঙালির পারিবারিকতার উৎসব। দেশভাগের আগে পুব বাংলার নানা গ্রামের দিকে ফিরতেন কলকাতা বা অন্য শহরে কাজ করতে আসা পেশাজীবী বাঙালি ভদ্রলোক, ‘দেশের বাড়ি’ যাওয়ার ভিড় জমত স্টেশনে কিংবা নদীর ঘাটে। সকলেই গৃহমুখী, এবং গৃহ যে-হেতু শহর থেকে দূরে, সেই জন্য শহরে ভিড় হয়ে যেত হালকা। এখনকার কথা বলার প্রয়োজন নেই, সকলেই অবগত আছেন কেমন ভাবে ভিড় এখন ধাবিত হয় মহানগরতীর্থে। লক্ষণীয় যা, তা হল কী ভাবে এই সময়কালের মধ্যে বাংলার চালচিত্র পাল্টেছে, নগরায়ণের ধরনে এসেছে গতিশীলতা। স্থানগত চলাচল ছাড়াও পারিবারিকতার উৎসব পাল্টেছে অন্যান্য দিক দিয়েও। এক স্থানে থেকেও পরিবার একত্র হওয়ার চল গিয়েছে পাল্টে, এমনকি এখনকার অল্পবয়সিদের কত জন বিজয়ার দিন পরিবারের বড়দের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম জানানোর সেই বহুপুরনো রীতিটি মানে কিংবা জানে, তা নিয়ে সমীক্ষা করা যেতে পারে। বলা যায়, পুজো এখন পারিবারিকতার গণ্ডি ছাড়িয়েছে। আবার এ-ও বলা যায় যে, পুজো এখন অণু-পরিবারের কন্দরে সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠেছে। এখনকার পুজোয় মিলন বা সম্মিলনের ধারণাটিই গিয়েছে পাল্টে।
পুজোর গান বা শারদ সাহিত্যের ধারা এখন কত অন্য রকম, এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। থিম-পুজো এসে কী ভাবে বারোয়ারি পুজোর ধাঁচটিকে ভেঙে দিয়েছে, বিস্তর হাহুতাশ চলে তা নিয়েও। উৎসবের বহিরঙ্গের এই সব পরিবর্তনের পিছনে পুঁজির চরিত্র ও আকার পাল্টানো যে একটি বড় কারণ, তাও এত দিনে যথেষ্ট আলোচিত। এই একই ধনতান্ত্রিক বিবর্তনই কিন্তু সমাজ ও পরিবারের গঠন পাল্টানোর কারণ, যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যক্তিজীবনের পরিসরটিও পুনর্নির্মিত হয়েছে। পুজোয় পারস্পরিক উপহার বিনিময়ের প্রথাটির ক্রমবিবর্তন দেখলেও বোঝা যাবে, কী ভাবে এই নব্য-ধনতান্ত্রিক পরিসর ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে পড়েছে সমাজের নানা স্তরে। মানুষের সামাজিক জীবন আসলে একটি গতিময়তার পরিসর, স্বাভাবিক ভাবেই, কিছু কিছু ঐতিহ্যবাহী উৎসব দিয়ে তাকে এক অপরিবর্তনীয়তা আর ধ্রুপদীয়ানার আবরণ দেওয়ার প্রয়াস চলে। অবশ্যই সেই আবরণটিরও গুরুত্ব অনস্বীকার্য— এক-একটি জনসমাজকে তার বিশিষ্ট চরিত্র ধরে রাখতে তা সাহায্য করে। তবে সেই আবরণটিকেই সত্য ও প্রধান ভাবলে ভুল হবে। রাত পোহালে নতুন শারদ প্রাতের রোদ কেবল স্মরণপথের উদ্ভাসে পুরনোকে আলো দিয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy