Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Schools

শিক্ষকের কাজ

শিক্ষা দফতর যে ‘উপর থেকে নীচে’ মডেল অনুসরণ করছে, সেটাই আসল সমস্যা। সরকারি আধিকারিকের কাছে শিশুরা মুখহীন অবয়ব মাত্র।

শিক্ষকদের ছাত্রকল্যাণের রূপকার বলে স্বীকার করতে হবে।

শিক্ষকদের ছাত্রকল্যাণের রূপকার বলে স্বীকার করতে হবে।

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৬:০০
Share: Save:

শিক্ষকের কাজ কী, সে প্রশ্ন আবার এল বিতর্কের কেন্দ্রে। প্রধান শিক্ষকদের একটি সংগঠন শিক্ষা দফতরের শীর্ষ কর্তাদের চিঠি লিখে জানাল, বর্তমানে সরকারের সতেরোটি প্রকল্পের দায়িত্ব তাঁদের সামলাতে হয়। এর ফলে তাঁদের যা মূল কাজ, শিক্ষকতা এবং স্কুল পরিচালনা, তাতে ব্যাঘাত ঘটছে। তাই কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রীর মতো প্রকল্পের দায়ভার থেকে তাঁরা অব্যাহতি চেয়েছেন। তাঁদের দাবি গুরুত্বের সঙ্গে এবং ধৈর্যের সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা দরকার। প্রশ্নটি জটিল এবং বহুস্তরীয়। ‘ক্লাসের পঠনপাঠন ছাড়া আর কিছুই শিক্ষকের দায়িত্ব নয়’, একবিংশের ভারতে দাঁড়িয়ে এই অবস্থান মেনে নেওয়া যায় না। আবার, ‘স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা-সম্পর্কিত সব প্রকল্পই শিক্ষকের দায়িত্ব’, এই অবস্থানও অন্যায্য এবং অবাস্তব। গ্রহণযোগ্য বিকল্প এর মাঝামাঝি কোথাও রয়েছে। তার নির্ণয় করতে গেলে কয়েকটি মৌলিক সত্যকে গোড়াতেই মেনে নেওয়া প্রয়োজন। এক, স্কুলের প্রধান কাজ শিক্ষাদান। দুই, স্কুলের প্রধান কাজ পঠনপাঠন, এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কযুক্ত কর্মসূচির পালন। তিন, সরকার, বা সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষক ‘সরকারি কর্মচারী’ নন। এই তিনটি সত্যকে অক্ষরেখা হিসেবে ধরলে যে ক্ষেত্র নির্মিত হয়, তাতে কর্তব্য নির্দিষ্ট করা কঠিন নয়। প্রথমত, ভোটার তালিকা তৈরি, বা নির্বাচন-সম্পর্কিত কোনও কাজে শিক্ষকদের নিয়োগ অন্যায়। নির্বাচন বা অন্য কোনও রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কাজে স্কুলভবনের ব্যবহারও অন্যায়। এটা ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। দ্বিতীয়ত, মিড-ডে মিল প্রকল্পের সঙ্গে স্কুলে পড়ুয়াদের উপস্থিতির হারে বৃদ্ধি, এবং তাদের পড়াশোনার মানে উন্নতির সাক্ষাৎ সংযোগ আছে। অতএব মিড-ডে মিল প্রকল্পের তদারকি করবেন শিক্ষকরাই।

প্রধান শিক্ষকদের সংগঠনটি আপত্তি করেছে, সরকার মিড-ডে মিলে এতই কম বরাদ্দ করেছে যে খাবারের মান মন্দ হচ্ছে, তার জন্য পড়ুয়া ও অভিভাবকদের ক্ষোভ সহ্য করতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষকের হেনস্থা অবশ্যই অনভিপ্রেত, কিন্তু শিক্ষকের প্রতি প্রশ্ন, তিনি নিজের সমস্যাকে আগে রাখবেন, না কি পড়ুয়াদের প্রতি বঞ্চনাকে? বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের সংগঠিত দাবিই এর উত্তর, পুষ্টিপ্রকল্পের দায় এড়ানো নয়। তেমনই, পাঠ্যবই বিতরণেও শিক্ষককে যুক্ত থাকতে হবে। কিন্তু ব্যাগ, জামা, সাইকেল প্রভৃতি বণ্টনের দায় তাঁর হবে কেন? এগুলির জন্য জেলা প্রশাসন, বা পঞ্চায়েত-পুরসভা থেকে কর্মীদের ‘ডেপুটেশন’-এ স্কুলে পাঠানো যেতে পারে। শিক্ষক ক্লাসে না গিয়ে প্রাপক-তালিকা প্রস্তুত করবেন, এটা মানা চলে না।

শিক্ষা দফতর যে ‘উপর থেকে নীচে’ মডেল অনুসরণ করছে, সেটাই আসল সমস্যা। সরকারি আধিকারিকের কাছে শিশুরা মুখহীন অবয়ব মাত্র। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কিন্তু প্রতিটি পড়ুয়া বিশিষ্ট। তাদের কার কী দরকার, তা শিক্ষকরাই উপলব্ধি করতে পারেন। তাই স্কুলের স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধিকার স্বীকার করতে হবে সরকারকে। স্কুলই বুঝবে, কোন ছাত্রছাত্রীকে কোন প্রকল্পের সুবিধা দেওয়া দরকার। শিক্ষকদের সুপারিশকে অনুমোদন করতে পারে স্কুলশিক্ষা কমিটি, অভিভাবকদের সভা। প্রকল্প রূপায়ণে যদি সরকারকে শেষ অবধি শিক্ষকের উপরেই ভরসা করতে হয়, তা হলে তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেবে না কেন? শিক্ষকদের সরকারি ‘কেরানি’ না করে তুলে, তাঁদেরই ছাত্রকল্যাণের রূপকার বলে স্বীকার করতে হবে। সরকারি আধিকারিকরা বিবিধ প্রকল্পের ‘অডিট’ করে দেখতে পারেন, অপচয় হল কি না, যোগ্য পড়ুয়া বঞ্চিত হল কি না। কিন্তু শেষ অবধি শিক্ষার কাজটিতে স্থিত রাখতে হবে শিক্ষককে‌ই, শিক্ষা আধিকারিক প্রমুখ কিন্তু সেখানে পরবর্তী স্তরে।

অন্য বিষয়গুলি:

Schools headmaster Kanyashree
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy