দক্ষিণ দিল্লি পুরসভার মেয়র ও বিজেপি নেতা সম্প্রতি চৈত্র নবরাত্রিতে এলাকার সব মাংসের দোকান বন্ধ রাখার সওয়াল করলেন। মেয়রের বক্তব্য: হিন্দু ব্রতপালনকারীরা এই সময় উপবাস করেন, নিরামিষ খান, মন্দির দর্শন, পূজা-প্রার্থনা করেন। এ সময় যাতায়াতের পথে মাংসের দোকান চোখে পড়লে বা গন্ধ নাকে এলে ধর্মীয় চেতনা আহত হবে, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মাংসের অবশেষ নিয়ে পথকুকুরের টানাটানিও ব্রতপালনকারীর শরীর-মনের স্বাস্থ্যহানিকর। চিত্তরঞ্জন পার্ক এলাকাতেও এই সময়েই মাছ-বিক্রেতাদের হাতে নোটিস এল, তাঁদের দোকান-বাজার বসানোর নিয়ম পালনে গলদ আছে, সব বন্ধ করতে হবে। রামনবমীর দিন জেএনইউ-এ এবিভিপি-র ছাত্র-সমর্থকরা চড়াও হল হস্টেলে মাংস পরিবেশন করা নিয়ে, হানাহানিতে রক্তও ঝরল। আমিষ খাওয়া নিয়ে এই ভারতে সংঘর্ষকাতরতা স্পষ্টতই ক্রমবর্ধমান।
দেশ চলে সংবিধানে, ধর্মে নয়; সংবিধানই ভারতের নাগরিককে নিজ মত ও শর্তে জীবন যাপনের অধিকার ও স্বাধীনতা দিয়েছে, এবং সেই অধিকারসমূহের মধ্যে নিজস্ব খাদ্যাভ্যাসের অধিকারটিও সুরক্ষিত, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই কথাটি বুঝতে নারাজ। আমিষ প্রসঙ্গে তাদের যুক্তিটি তাদের উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতিরই অঙ্গ, এবং সেই রাজনীতির মতোই গোঁড়া, অসংবেদনশীল ও অবিবেচক। ভারতের সংবিধান-স্বীকৃত জীবন যাপন, ধর্মাচরণ ও খাদ্যাভ্যাসের স্বাধীনতার নিহিতার্থই এই— যিনি যেমন মতে পথে চর্যায় বিশ্বাসী বা অভ্যস্ত, তাঁর সেই বিশ্বাস ও অভ্যাসের পরিবেশ সুনিশ্চিত করা। ব্রতপালনকারী উপবাসী বা নিরামিষাশী বলে সহ-নাগরিকদের মাছ-মাংস খাওয়ায় বা বেচাকেনায় শুধু শাসকেরই নয়, কারও নিষেধাজ্ঞাই চেপে বসতে পারে না— এ-হেন পদক্ষেপ মাত্রেই অসাংবিধানিক, অবৈধ, মানবাধিকার বিরোধী। কয়েক বছর আগে মহারাষ্ট্র গোমাংস নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে আইন সংশোধন করতে গেলে বম্বে হাই কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলেছিল, “ক্ষতিকর নয়, এমন কোনও খাদ্যবস্তু নাগরিক ঘরে রাখলে বা খেলে রাষ্ট্র কোনও ভাবেই তাতে বাধা দিতে পারে না; প্রত্যেক নাগরিকেরই নিজের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে, এবং বাইরেও— অর্থপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার আছে।” নাগরিকের খাদ্যাভ্যাসের স্বাধীনতা সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদে বলা ‘জীবনের অধিকার’-এর অঙ্গাঙ্গি।
সংবিধানে যে কথা পরিষ্কার লেখা আছে, আদালত বিভিন্ন সময়ে যা পালন করার সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে, কেন্দ্রে শাসক তা মানতে নারাজ, বরং ক্ষমতার জোরে এবং ধর্মীয় চেতনা তথা ভাবাবেগকে রাজনীতির অস্ত্র করে মুহুর্মুহু তা লঙ্ঘন করে চলেছে। এই সবই বুঝিয়ে দেয়, শাসক চাইছে এক অতিনিয়ন্ত্রিত, একতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। আমিষ বন্ধ করা নিয়ে সওয়াল, হস্টেলে মাংস পরিবেশন নিয়ে ছাত্র শাখার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি— এই সবই সেই উদগ্র রাজনৈতিক বাসনার বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সর্ব ক্ষেত্রেই বিজেপির এই ছকটি মাথাচাড়া দিচ্ছে। এই কৌশলকে সর্ব ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করাই এখনকার ভারতের কর্তব্য। নাগরিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে, সংবিধান ও গণতন্ত্রের সুস্থতার স্বার্থেই। নইলে যে বহুত্ববাদী সামাজিক সংস্কৃতি ভারতের প্রাণভ্রমরা, তা বাঁচবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy