সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত।
বিরোধী নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী— রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এ ভাবেই দেখা বিধেয়, বললেন সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত। নাগপুরে সঙ্ঘের শিক্ষানবিশদের সভায় কথাটি বলা হলেও উক্তিটি কাদের উদ্দেশে, অনুমান করতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ভাগবত আরও বলেছেন যে, ‘ভোটের সময় মর্যাদা পালন করা হয়নি’। কেউ বলতেই পারেন যে, শুধু এই নির্বাচনের সময় নয়, গত দশ বছরে প্রায় কখনও বিরোধীরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাননি। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার গণতন্ত্রের ধর্ম বিস্মৃত হয়েছিল। এ দফায় পরিস্থিতি ভিন্ন। বিজেপি সরকার গঠন করেছে বটে, কিন্তু জোটসঙ্গীদের উপরে নির্ভর না করে তার উপায় নেই। এই অবস্থায় বিরোধীদের সম্পূর্ণ অসহযোগ সরকারের উদ্বেগ বাড়াবে বই কমাবে না। তবে, শুধু এই কারণেই ‘মর্যাদা পালন করা’ গুরুত্বপূর্ণ নয়। গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই, এবং উভয় পক্ষই অপর পক্ষকে চাপে রাখারও চেষ্টা করবে। কিন্তু, সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামোয় দেশের স্বার্থকে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে রাখতেই হয়। বিরোধী পক্ষের মূল কাজ সরকারকে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থসিদ্ধির পথে অবিচলিত রাখা— তার জন্য সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপকে বিরোধীরা বিশ্লেষণ করবেন, তার দোষত্রুটি নির্দেশ করবেন। সেই কাজটি দেশের স্বার্থেই জরুরি— তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যেই দেশের ক্ষতির বীজ নিহিত থাকে। বিরোধীদের সমালোচনা থেকে দিকনির্দেশ নিয়ে নিজেদের পথের ভ্রান্তিগুলি সংশোধন করে নেওয়াতেই শাসকের সাফল্য। জেতা-হারার হিসাব তো নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে— বিরোধীদের বাক্স্বাধীনতা খর্ব করে, অথবা তাঁদের কথাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে আর নতুন কোনও জয়সঙ্কেত প্রেরণ করা যায় না। বরং, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সহযোগিতার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পথে চলতে পারার মতো পরিণতমনস্কতাই শাসনের নৈতিক অধিকারকে পোক্ত করে। নরেন্দ্র মোদীরা দশ বছরে এ কথাটি বোঝেননি। এ বার বুঝবেন কি?
বোঝার মতো কথা অবশ্য বিরোধীদের জন্যও আছে। এই নির্বাচনে তাঁদের সম্মিলিত ফল গত দু’দফার চেয়ে ভাল। কিন্তু, গত দু’দফার তুলনায় বিজেপি এবং এনডিএ জোটের প্রাপ্ত আসনসংখ্যা কমলেও তা এই দফায় বিরোধীদের মোট আসনসংখ্যার চেয়ে বেশি— যথেষ্টই বেশি। ফলে, ভারতীয় গণতন্ত্রের রীতি মেনে তারাই সরকার গঠনের জন্য যোগ্য পক্ষ। সেই সরকারের বৈধতাকে প্রশ্ন করা মানে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকেই প্রশ্ন করা, জনাদেশকে অসম্মান করাও বটে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা বা তার অভাব নিয়ে বিরোধীদের মনে ক্ষোভ থাকতে পারে, সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান বয়কট করাকে কেউ সেই ক্ষোভ প্রকাশের পন্থা হিসাবেও দেখতে পারেন। তবে, সেই ক্ষোভকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিরোধীরা নিজেদের গণতান্ত্রিক ভূমিকা বিস্মৃত হলে তা দুঃখজনক হবে। সরকারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ও সহযোগিতার— শত্রুতার নয়। মেয়াদ ফুরানোর আগেই যদি তাঁরা প্রমাণ করতে পারেন যে, সংসদে এই সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, তা হলে সরকার ভেঙে যাবে। কিন্তু, যত ক্ষণ এই সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ, তত ক্ষণ তার প্রতি বিরোধীদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলে বিজেপি সরকারকে অচল করে দেওয়ার যে নেতিবাচক রাজনীতির অনুশীলন করেছিল, তা কোনও মতেই অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্ত নয়। বিরোধীরা বরং ব্রিটিশ রাজনীতির থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্যাডো ক্যাবিনেট গঠন করার কথা ভাবতে পারেন। তাঁরা সরকারে থাকলে কোনও প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান কী হত, ইত্যাদি। মূল কথা হল, শাসক এবং বিরোধী, উভয় পক্ষই যদি পারস্পরিক শত্রুতা বিস্মৃত হয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করেন, একমাত্র তা হলেই এগোনো সম্ভব। নচেৎ, শত্রুতাই সার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy