Advertisement
E-Paper

 কে দিল আঘাত

উদ্বাস্তু সমস্যা আজও উনিশশো সাতচল্লিশের দেশভাগের গভীর ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তপ্রবাহ।

শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২১ ০৪:৩৭
Share
Save

কেবল স্বাধীনতা লাভের দিনটির নহে, দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ঘটনারও চুয়াত্তর বৎসর পূর্ণ হইল। ডালপালা ছড়াইয়া থাকা ভারতবর্ষের পুরাতন মানচিত্রটির দুই দিকে দুই ডানা কাটিয়া তাহার যে নূতন অবয়ব— তাহাও গত কাল পা দিল পঁচাত্তরে। আনুমানিক প্রায় দেড় কোটি মানুষকে উৎখাত করিয়া বিশ্বের বৃহত্তম ‘পার্টিশন’— এই সাংঘাতিক ঘটনার প্রথম ও প্রধান দায়— ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। তবে সে কালে রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, এমনকি কংগ্রেসের নেতারাও সেই সিদ্ধান্তের নৈতিক ভাগীদার। আজিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশীয় নেতাদের কাহার কী দায়িত্ব ছিল, সেই বিষয়ে কাটাছেঁড়া হইতেছে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, নির্মম ভৌগোলিক খণ্ডনের দ্বারা নূতন দেশ দাঁড় করাইয়া দিবার প্রবণতাটি কিন্তু ঔপনিবেশিক শক্তিরই মজ্জাগত অভ্যাস।

কেবল ভারত নহে। এশিয়া ও আফ্রিকার অ‌ধিকাংশ উপনিবেশের ভূগোল এই পদ্ধতিতে পাল্টাইয়া তাহাদের ইতিহাসের ধারা পাল্টাইয়া গিয়াছেন এই দুই মহাদেশের পূর্বতন ঔপনিবেশিক শাসকেরা। আজ যদি দেশগুলি নিজেদের দিকে তাকাইয়া অবাক হইয়া ভাবে, কে তাহাদের সীমারেখা আঁকিয়া দিল, কে বলিয়া দিল, ইহাই আজ হইতে তোমাদের দেশ, ডাইনে বামে আর তাকাইয়ো না, কে তাহাদের নিজেদের মধ্যে অঞ্চলের ভাগাভাগি লইয়া মারামারি লাগাইয়া সংঘর্ষসাগরে ডুবাইয়া দিল— তবে উত্তর একটিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবে বিপন্ন ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকেই এই দায় বহন করিতে হইবে। অত্যন্ত তাড়ায় তাহাদের উপনিবেশগুলি ছাড়িতে হইয়াছিল। সেই তাড়ারই অভ্রান্ত ছাপ উপনিবেশিত দেশগুলির মানচিত্রে। উপনিবেশ-উদয় ও উপনিবেশ-অস্তের সময়কার ইউরোপীয় স্বার্থহিসাবের ঐতিহাসিক দাম আজও প্রতি দিন মিটাইতেছে এশিয়া ও আফ্রিকা।

পঁচাত্তর বৎসরে পড়িয়াও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বহু সহস্র পরিবার নিজেদের আপনজনকে হারাইবার যন্ত্রণায় দগ্ধ, ঘরবাড়ি সম্পদ ফেলিয়া আসিয়া দুঃসহ আস্তিত্বিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। উদ্বাস্তু সমস্যা আজও উনিশশো সাতচল্লিশের দেশভাগের গভীর ক্ষত থেকে চুইয়ে পড়া রক্তপ্রবাহ। পশ্চিমবঙ্গবাসীকে এই সব কথা নূতন করিয়া মনে করাইয়া দিতে হইবে না— কাশ্মীরবাসীকেও নহে। আজও কাশ্মীর বিশ্বমঞ্চে ‘দেশভাগের অসমাপ্ত অধ্যায়’ হিসাবে পরিচিত— দগ্ধ, ক্ষতবিক্ষত। কালক্রমে বিভক্ত জার্মানির ভাগ জুড়িয়া গিয়াছে। বিভক্ত আয়ার্ল্যান্ডের কঠিন যবনিকা (‘হার্ড পার্টিশন’) সরিয়া গিয়া নরম বিভাজন (‘সফট পার্টিশন’) প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। ভারত ও পাকিস্তান কিন্তু সমানেই পরস্পর হইতে দূরে সরিতেছে, তাহাদের শত্রুভাব দিনে দিনে বাড়িয়াছে। ফল দাঁড়াইয়াছে, এই সব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনও বিক্ষোভ বা বিদ্রোহে সাব-ন্যাশনালিজ়ম বা ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের গন্ধ পাইলেই হিংস্র হইয়া উঠে এই রাষ্ট্রগুলি। সিঁদুরে মেঘ দেখিবার মতো, এই সব ‘ডিকলোনাইজ়ড’ রাষ্ট্রের প্রকৃতিগত ধরনটিই যেন ত্রস্ত, সংশয়গ্রস্ত— রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যাহাকে বলিবেন ‘ফিয়ারফুল স্টেট’। এই কারণেই স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র কাশ্মীর, পঞ্জাব, উত্তর-পূর্বে অসম্ভব নির্দয় হইতে অস্বস্তি বোধ করে না। এই কারণেই মহাদেশসমান বৃহৎ দেশ ভারতীয় রাষ্ট্র আঞ্চলিক সত্তা-পরিচয়ের সহিত সুস্থ ভাবে কথোপকথন করিতে পারে না, তাহাদের আস্থা জোগাইতে পারে না। যে মানচিত্র প্রাক্তন সাম্রাজ্যবাদী শাসক ভারতের মাথায় বসাইয়া দিয়া গিয়াছে, স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতীয় রাষ্ট্র তাহাকেই চিরকালীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবিতে অভ্যস্ত হইয়াছে। নিজেকে সেই মানচিত্রের অধীশ্বর ভাবিয়াছে। ইহা ইতিহাসের উত্তরাধিকার। ইতিহাসের পরিহাসও বটে।

Partition 75th Independence Day

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}