অর্ধস্খলিতবসনে বিক্ষিপ্তকেশে কৌরবসভাস্থলে আনীত দ্রৌপদী দুঃশাসনকে তীব্র ভর্ৎসনা করিবার পরে যে কথাগুলি বলিয়াছিলেন, রাজশেখর বসুর ভাষায় তাহা এইরূপ: “এই কুরুবীরগণের মধ্যে আমাকে টেনে আনা হ’ল কিন্তু কেউ তার নিন্দা করছেন না! ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না? ধিক্, ভরতবংশের ধর্ম আর চরিত্র নষ্ট হয়েছে, এই সভায় কৌরবগণ কুলধর্মের মর্যাদালঙ্ঘন নীরবে দেখছেন!” যাজ্ঞসেনীর নিদারুণ নিগ্রহের সম্মুখে হস্তিনাপুরের কুরুবীরগণ কে কেন নীরব থাকিয়াছিলেন, মহাভারতের পাঠক ও শ্রোতারা তাহা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ না করিয়া, তাহার প্রতিরোধে সর্বশক্তি প্রয়োগ না করিয়া নীরব থাকা যে ভয়ানক রকমের নীতিবিরোধী অপরাধ, দ্রৌপদীর তিরস্কার সেই সত্যটিকেই নির্ভুল ভাবে চিহ্নিত করে। ক্ষমতাবানেরা যখন নীরবতা পালন করেন তখন এই অপরাধ বহুগুণ বেশি হয়, আর তাহা চরম মাত্রায় পৌঁছাইয়া যায়, যখন দুঃশাসনী কুকীর্তিগুলি সম্পাদন করেন ওই ক্ষমতাবানদেরই সহমর্মী বা অনুগামীরা।
কালের বিচারে দ্বাপরের হস্তিনাপুর হইতে ঘোর কলির দিল্লি বহুদূরবর্তী। কিন্তু নীরবতা যে কত বড় অন্যায়ের সূচক হইতে পারে, নরেন্দ্র মোদী শাসিত ভারত তাহা বিস্ফারিতনয়নে দেখিতেছে। হরিদ্বারের তথাকথিত ধর্ম সংসদ হইতে শুরু করিয়া দেশের নানা স্থানে নানা উপলক্ষে উগ্র হিন্দুত্বের স্বনিযুক্ত ইজারাদারদের বয়ানে নিরাবরণ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের যে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার চলিতেছে তাহা কেবল চরম অনৈতিক নহে, তাহা সরাসরি দেশকে ‘টুকরো টুকরো’ করিবার হিংস্র প্ররোচনা দেয়। অথচ, সরকারি নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ করিলে যে রাষ্ট্র চণ্ডশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়ে, প্রতিবাদীদের দেশদ্রোহীর তকমা দেয়, হুমকি দেয়, বছরের পর বছর কয়েদ করিয়া রাখে, এই হিংস্র সাম্প্রদায়িক প্ররোচনার অপরাধ দমনের প্রচেষ্টা দূরস্থান, প্ররোচকদের মৌখিক নিন্দাও সেই রাষ্ট্রের চালকদের মুখে শোনা যায় না। স্পষ্টতই, বিদ্বেষ ও হিংসার কারবারিরা ইহাতে প্রশ্রয় পায়, যে প্রশ্রয় কেবল তাহাদের প্রচারে ইন্ধন জোগায় না, ইন্ধন জোগায় আক্রমণেও। আক্রমণের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য সংখ্যালঘুরা, কিন্তু তাহা একই সঙ্গে উদার গণতন্ত্রের মর্মমূলে আঘাত হানে। সম্প্রতি দেশের ভূতপূর্ব সামরিক কর্তাব্যক্তি, প্রশাসক, সমাজকর্মী এবং বিভিন্ন বর্গের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বহু সদস্য প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতি-সহ রাষ্ট্রনায়কদের উগ্র হিন্দুত্বের এই আক্রমণের নিন্দা করিতে এবং তাহা বন্ধ করিতে আহ্বান জানাইয়াছেন। তাঁহাদের চিঠির বক্তব্য এবং তাহার ভাষায় যে গভীর উদ্বেগ, তাহা কেবল স্বাভাবিক নহে, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু শাসকরা কি ইহাতে কিছুমাত্র বিচলিত হইবেন? এই সাম্প্রদায়িকতার প্রচার অহেতুক বা অপরিকল্পিত বলিয়া মনে করিবার কারণ নাই, বরং তাহাকে দেশের সমাজকে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বিভাজিত করিয়া নির্বাচনী রাজনীতির ফসল তুলিবার প্রকরণ হিসাবে গণ্য করিবার যথেষ্ট হেতু আছে। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন আসন্ন হইবার সঙ্গে এই প্রচারের নূতন মাত্রা বুঝিতে কিছুমাত্র অসুবিধা নাই। মুজফফরনগরের স্মৃতি এখনও বিবর্ণ হয় নাই। এমন সংশয় স্বাভাবিক যে, রাষ্ট্র যাঁহারা চালাইতেছেন, তাঁহাদের সম্মতি তথা অনুপ্রেরণাতেই ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রচার অভিযান সংগঠিত হইতেছে; তাঁহাদের নীরবতা নিছক অন্যায়ের প্রশ্রয় নহে, অন্যায়ের পরিকল্পিত অঙ্গ। ‘ধর্ম সংসদ’ আদি প্ররোচকদের প্রচার যতটা ভয়ঙ্কর, এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী-সহ রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যত সমস্ত নায়কদের প্রগাঢ় নীরবতা তাহার অপেক্ষা আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy