আর জি কর-কাণ্ডের নিন্দা করলেই বঙ্গীয় শাসককুল তারস্বরে বলে চলেছেন, এই অগস্ট মাসেই দেশ জুড়ে আরও অজস্র ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ভাবখানা এমন, যেন দেশের অন্যত্রও একই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গে ঘটে যাওয়া এই নারকীয় কাণ্ডের ভয়াবহতা বা গুরুত্ব তিলমাত্র হ্রাস পায়! তবে, অস্বীকার করা যাবে না যে, সত্যই বিভিন্ন রাজ্যে ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের ঘটনা। আক্রান্তদের মধ্যে সত্তর অতিক্রান্ত বৃদ্ধা আছেন, তিন বছরের শিশুকন্যা আছে; নার্স আছেন, স্কুলছাত্রী আছে। নিদেনপক্ষে একটিও ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশিত হয়নি, এমন এক দিনের সংবাদপত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এবং, শুধু অগস্ট মাসের কথা নয়, ভারতে ধর্ষণ একেবারে জলভাত হয়ে উঠেছে বেশ কিছু বছর ধরেই। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। এই পরিসংখ্যান হিমশৈলের চূড়ামাত্র— সামাজিক গ্লানি, পারিবারিক বাধার মতো হরেক কারণে দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের একটি বড় অংশের খবর থানা অবধি পৌঁছয় না। স্পষ্টতই ধর্ষণ কোনও একটি শহরের, কোনও একটি রাজ্যের বা কোনও একটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সমস্যা নয়— এটি এক সর্বভারতীয় সমস্যা। রাজ্যে রাজ্যে অবশ্যই অপরাধের সংখ্যার তারতম্য রয়েছে, কিন্তু এটাও সত্য যে, ভারতের কোনও রাজ্যেই মহিলারা সম্পূর্ণ নিরাপদ বোধ করতে পারেন না। এ ভারতের জাতীয় লজ্জা— তাকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করলে মূল প্রশ্নটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়।
ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির নিরিখে সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গকে মহিলাদের পক্ষে বিশেষ ভাবে বিপজ্জনক বলা মুশকিল। এনসিআরবি (২০২২)-র পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে প্রতি লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় যেখানে ৪.৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এই হার ২.৩। রাজস্থান, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই হার পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েক গুণ। অন্তত ২০ লক্ষ মানুষ বাস করেন, দেশের এমন ১৯টি শহরের মধ্যে ২০২২ সালে প্রতি এক লক্ষ মহিলা জনসংখ্যায় ধর্ষণের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছিল কলকাতাতেই— ০.২টি। সর্বভারতীয় গড় ৬.৭; রাজস্থানের জয়পুরে এই হার ছিল ৩৪.২, দেশের রাজধানী দিল্লিতে ১৫.৯, এমনকি মহিলাদের পক্ষে নিরাপদ শহর হিসাবে পরিচিত মুম্বইয়েও এই হার ছিল ৪.৩। সংঘটিত ধর্ষণের একটি অংশের কথা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয় না, এই সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখলেও পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতাকে দেশের অন্য রাজ্য বা মহানগরের তুলনায় অ-নিরাপদ বলা যায় না। এই পরিসংখ্যান যেমন আর জি কর-কাণ্ডের ভয়াবহতাকে তিলমাত্র হ্রাস করে না, আবার একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে, একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা বহুআলোচিত হলেই, বা তাকে কেন্দ্র করে বিপুল জনআন্দোলন গড়ে উঠলেই তা রাজ্যের প্রকৃত ছবিটিকে পাল্টে দিতে পারে না।
গোটা আলোচনাটিই রাজনৈতিক চাপান-উতোরে পর্যবসিত হলে এই ছবিগুলি চোখ এড়িয়ে যেতে থাকে। যেমন, রাষ্ট্রপতি আর জি কর-কাণ্ডে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সম্ভবত পরিস্থিতির উত্তাপেই বৃহত্তর ছবিটির কথা বিস্মৃত হয়েছেন। ভারতের দুর্ভাগ্য, এমন একটি ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও, এমন একটি গুরুতর বিষয় নিয়েও শুধু রাজনীতিই চলে। অন্যত্র ধর্ষকদের জয়মাল্যে বরণ করে নেওয়া বিজেপি যেমন পশ্চিমবঙ্গে ধর্ষিতার ন্যায়বিচারের দাবিতে রণোন্মত্ত, তেমনই বঙ্গীয় শাসককুলও কেবলই দায় ঝেড়ে ফেলতে ব্যস্ত। তার চেয়ে, সব পক্ষই যদি বৃহত্তর ছবিটির দিকে নজর রেখে সার্বিক সমাধানের পথ সন্ধান করত, যদি অন্তত একটি বারের জন্য রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে পারত, তা হলে হয়তো পরিস্থিতি খানিক হলেও পাল্টাত। কিন্তু, এ পোড়া দেশে তেমন আশা করার সাহস বুঝি কারও নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy