জীবন বিচিত্র। নির্ধারিত পথ ও মত মানিয়া যে সে চলিবে তাহা নহে। তথাপি মতাদর্শবাদীরা কোনও না কোনও ছাঁচে কিংবা মাপে জীবনকে চালাইতে তৎপর। ব্যক্তিজীবন মাত্র নয়, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনকে বাঁধিবুলিতে বিচার করিবার প্রচেষ্টা করেন তাঁহারা। যে-ক্ষণে তাহা আর সম্ভব হয় না সে-ক্ষণে তাঁহারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়েন। ভাবেন, পড়া বুলি শেখা তত্ত্ব ব্যর্থ যখন, তখন আর কী বা রহিল? ইহা তাঁহাদেরই সমস্যা। আদর্শবাদ ভাল, কিন্তু আদর্শবাদের অহমিকা ও অপরিবর্তনীয় শুচিবায়ুগ্রস্ততা ভাল নহে। কিন্তু আদর্শ বলিয়া কি তবে কিছুই থাকিবে না? নৈরাজ্যই অন্তিম পন্থা? বিষয়টি রবীন্দ্রনাথকেও ভাবাইয়াছিল। তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন ইতিহাস বড় নির্মম। এই নির্মমতাই এক অর্থে ‘মানুষের ধর্ম’। এক কালে যে সকল বিধি ও আদর্শকে মানুষ মাথায় করিয়া রাখিয়াছিল, আর এক কালে সেই সকল বিধি ও আদর্শকে ভাঙিয়া তাহারা পথে নামিয়া পড়িলে আশ্চর্য হইবার কারণ নাই। বরং তাহাই স্বাভাবিক বলিয়া ধরিতে হইবে। ইহাকেই বলা চলে ‘অনাগারিক’ মানুষের ব্রত। রবীন্দ্রনাথের মতে, এই ধর্মেই মানুষ পশু হইতে পৃথক। পশুর জন্য নির্দিষ্ট রহিয়াছে গুহা, মানুষের জন্য উন্মুক্ত রহিয়াছে পথ। গুহামুখী পশু তাহার স্বধর্মের ছাঁচে শেষ অবধি আটকাইয়া থাকে। কিন্তু পথে নামিয়া মানুষ অজানার উদ্দেশে অগ্রসর হয়, তাহার কোনও স্থির-নিশ্চিত আগার নাই, সে কারণেই মানুষ অনাগারিক। অনাগারিক মানুষ কী সন্ধান করিতেছে? রবীন্দ্রনাথ বলিবেন, মানুষের মঙ্গল। কিন্তু মঙ্গল আগে যে পথে আসিয়াছে সেই পথেই যে আসিবে তাহার নিশ্চয়তা নাই। প্রয়োজনে নূতন পথ খুঁজিতে হইবে।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবনে এ-কথা মানিয়া চলিতেন। এক সময় নিজ বিদ্যালয়ে ভারতীয় তপোবনের আদর্শকে, ব্রহ্মচর্যের ধারণাকে বড় করিয়া তুলিয়াছিলেন তিনি। পরে সেই আদর্শের উপরে অন্য নানা আদর্শের হাওয়া লাগিল, ব্রহ্মচর্যাশ্রমের রূপ বদলাইয়া গেল। ভারতীয় তপোবনের সীমায় বিশ্বভারতী আর আটকাইয়া রহিল না। বঙ্গভঙ্গের কালে যে স্বদেশি-সমাজের কথা বলিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেই সমাজের আদর্শ লইয়া পাশ্চাত্য ‘নেশন’-এর ভাবনাকে তিনি প্রতিহত করিয়াছিলেন। পরে, জীবনের শেষ দশকে আবার ভাবিতে বসিলেন নেশনের কি ভিন্নরূপ নির্মাণ সম্ভব! নিজেই নিজের ছাঁচ ও আদর্শকে ভাঙিতেছেন। কেবল দেশ ও সমাজের ক্ষেত্রেই নহে, সৃষ্টিক্ষেত্রেও তাঁহার এমন ভাঙাগড়া অনিবার্য বেগে চলিতেছে। যে বয়সে তিনি ‘তিনসঙ্গী’র গল্পগুলিতে নূতনের ঝলক লাগাইয়াছিলেন সেই বয়সে লেখকরা নবনির্মাণ তো দূরস্থান পুনরাবৃত্তির শক্তি পর্যন্ত হারাইয়া ফেলেন। রবীন্দ্রনাথ যেন ‘রাবীন্দ্রিক’ বলিয়া কোনও ছাঁচই বজায় রাখিতে নারাজ। তাঁহার এমন বেশ কিছু আত্মপ্রতিকৃতি রহিয়াছে, যাহা দেখিলে বিস্ময় জাগে। নিজের চির-পরিচিত সন্তসুলভ মুখাবয়ব ভাঙিয়া এ কাহাকে বাহির করিয়া আনিলেন? নিজের মুখ নিজে ভাঙিবার বিরল ক্ষমতা বুঝাইয়া দেয় তিনি যথার্থই নূতন মত-পথের পথিক। দেখিতেছেন, আগে যাহা ছিল তাহাকে ভাঙিয়া নূতন ভাবে অগ্রসর হওয়া যায় কি না!
বঙ্গবাসী অবশ্য আলস্যবিলাসী। ভাঙিবার ও সম্পূর্ণ নূতন করিয়া গড়িবার ঝক্কি তাহারা লইতে নারাজ। দায় পড়িলে পুরাতন মদ্যকে নব্য বোতলে পরিবেশন করাই তাহাদের অভ্যাস। অবশ্য এমন সময় আসিতে পারে যে-ক্ষণে পুরাতন রীতি-নীতি নিতান্ত অচল পয়সা। তখন? তখন নূতন পথ খুঁজিতে হইবেই। এ-ক্ষণে পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতিতে সেই মুহূর্ত উপস্থিত। পুরাতন ভাঙাইয়া আর চলিবে না। কোনও পূর্বসূরির বাঁধিবুলিই আজ এই সমাজকে সম্পূর্ণ ত্রাণ করিতে সক্ষম নহে। আর ইহাই আদর্শবাদীগণের মহান সঙ্কট। তাঁহারা হাত কামড়াইতেছেন, কোন পথে নিজেদের আগাইয়া লইয়া যাইবেন বুঝিতে পারিতেছেন না। তাঁহাদের এই হতোদ্যম অবস্থা দেখিয়া বলিতে ইচ্ছা করে: অমুকবাদ বা তমুকবাদীর তকমা ছাড়িয়া গোড়া হইতে শুরু করুন। যাহা গিয়াছে তাহা গিয়াছে। সেই পথে আর সাফল্য মিলিবে না, মঙ্গলও হইবে কি না বলা কঠিন। তাহার চাহিতে নূতন পথই কাম্য। সেই পথ জীবন ও মানুষের মধ্য হইতেই গড়িয়া উঠিবে। পুরাতন বুলির ছাঁচ হইতে বাহিরে আসিয়া জীবন ও মানুষের মধ্যে মিশিয়া যাওয়াই এ-ক্ষণে অগ্রগতির যথার্থ উপায়। রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। রবীন্দ্রনাথ আজ এই বঙ্গভূমিতে থাকিলে আর যাহাই করুন, দ্বার রোধ করিয়া আপন মতাদর্শের ভজনা করিতেন, পথের সন্ধানে বাহির হইয়া পড়িতেন।
যৎকিঞ্চিৎ
আইআইটি কানপুরের কী দুর্দশা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, এ বার নাইট্রোজেন থেকে অক্সিজেন তৈরির পথ দেখো। টুইটার অমনি মিম-রসে টইটম্বুর। কেউ নাইট্রোজেন আর অক্সিজেনের আদ্যক্ষর পাশাপাশি লিখে বলছেন, ওরা নেহাত অবলা, নইলে এটাই বলত, ‘নো!’ কেউ বলছেন, এ আর কী এমন, নাইট্রোজেনকে দু’কিলো চাল দিয়ে দিলেই নাম পাল্টে অক্সিজেন বনে যাবে। অ্যাদ্দিন অবিজ্ঞান-অপবিজ্ঞান নিয়ে দিন কাটছিল, সইল না, এ বার পিরিয়ডিক টেবিল উল্টোনোর দশা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy