Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Durga Puja 2024

সম্পদের ব্যবহার

শহরের পরিসর দখল করে যে ভঙ্গিতে বারোয়ারি পুজোর আয়োজন চলে, তার সঙ্গে কি রাজ্যের অন্য কোনও পরিচিত দুর্নীতির মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব? শহরের রাস্তা, আকাশ, বাড়ির সামনের ফুটপাত— এগুলি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এগুলি গণসম্পত্তি।

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৪ ০৪:১৯
Share: Save:

মুখ্যমন্ত্রীর অনুদান যাঁরা নিয়েছেন এবং যাঁরা ফিরিয়ে দিয়েছেন; যাঁরা উৎসবে ফিরতে চেয়েছেন এবং যাঁরা বলেছেন ‘প্রতিবাদ আর উৎসব একই সঙ্গে চলবে’; যাঁরা পুজোয় সনাতন ধর্মের উদ্‌যাপন দেখেছেন এবং যাঁরা একে ‘ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের আনন্দের পরিসর’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন, সেই বিপুল বিবিধের মাঝে একটি আশ্চর্য মিলন মহান আছে— তাঁরা কেউই প্রশ্ন করেন না, যে পরিসরে প্রতি বছর পুজো হয়, তার মালিকানা কার? বেশির ভাগ পুজোই হয় রাস্তা দখল করে; কিন্তু, যে পুজোগুলি ক্লাবের নিজস্ব জমিতে হয়, তাদের আয়োজনেরও বহর সেই নিজস্ব এলাকার গণ্ডি ছাপিয়ে এসে পড়ে গণপরিসরে— মণ্ডপে ঢোকার লাইনের জন্য রাস্তা দখল হয়, বিজ্ঞাপনী আয়ের জন্য দখল হয় এলাকার আকাশ। পুজোর আশেপাশের সব বাড়িতে আলোহাওয়া ঢোকা বন্ধ করে দেয় বিপুল মাপের হোর্ডিং। গৃহস্থের বাড়ির সামনে চব্বিশ ঘণ্টা চলতেই থাকে দৃশ্য-শ্রাব্য বিজ্ঞাপন, কারণ তাতেও উপার্জন হয় পুজো কমিটির। বাড়ির দরজার সামনের জায়গাটুকু দখল করে বসে স্টল। অর্থাৎ, দুর্গাপুজোকে ঘিরে যে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে, তার ভিত্তিতে রয়েছে জবরদখল। যে পরিসরটির উপরে পুজো কমিটির কোনও অধিকার নেই, তাকে ব্যবহার করেই চলে অর্থোপার্জন।

চলে, কারণ রাজনীতি তাকে চলতে দেয়; চলে, কারণ সমাজ এই দখলদারিকে ক্রমেই স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছে। যাঁদের বাড়ির সামনেটুকু দখল হয়ে যায়, অথবা গাড়ি নিয়ে অহেতুক বহু পথ ঘুরতে হয় গন্তব্যে পৌঁছতে, তাঁরাও এই ব্যবস্থা মেনে নিতে বাধ্য হন, কারণ না-মানলে বিপদ। এই দখলদারি চলে শাসক দলের অনতিপ্রচ্ছন্ন আশীর্বাদে, প্রশাসনের বরাভয়ে। কেউ বলতেই পারেন যে, এই আনন্দের পরিসর অগণিত মানুষের, তার জন্য কিছু সাময়িক অসুবিধা মেনে নেওয়াই বিধেয়। প্রথম কথা, মেনে নেওয়া আর মানতে বাধ্য হওয়ার মধ্যে যে অনতিসূক্ষ্ম ফারাক আছে, তা বিস্মৃত হওয়া সমাজের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। দ্বিতীয়ত, নাগরিক জীবনের ন্যূনতম সুবিধাগুলি পাওয়ার অধিকার কি সংখ্যাগরিষ্ঠের ফুর্তির শর্তাধীন হতে পারে? যদি একশো জনের আনন্দের বিরুদ্ধে মাত্র এক জন নাগরিকও নিজের অসুবিধার কথা বলতে চান, তাঁর সেই কথাটিকে গুরুত্ব দেওয়া সভ্য সমাজের ধর্ম হওয়া উচিত ছিল। উৎসবও সমাজেরই অঙ্গ, কিন্তু তার জন্য কারও কারও বেঁচে থাকাকে দুর্বিষহ করা চলে না। উচিত ছিল শহরের প্রান্তে কয়েকটি এলাকা বেঁধে দেওয়া, যেখানে খোলা জমিতে এই উৎসব হবে— সে জায়গায় যতগুলি পুজোর ঠাঁই হতে পারে, পুজোর সংখ্যা কোনও মতেই তার চেয়ে বেশি হবে না। কিন্তু, তেমন ব্যবস্থা ‘অকল্পনীয়’।

শহরের পরিসর দখল করে যে ভঙ্গিতে বারোয়ারি পুজোর আয়োজন চলে, তার সঙ্গে কি রাজ্যের অন্য কোনও পরিচিত দুর্নীতির মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব? শহরের রাস্তা, আকাশ, বাড়ির সামনের ফুটপাত— এগুলি কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এগুলি গণসম্পত্তি। ফলে, এগুলিকে বিক্রি করার অধিকার কারও থাকার কথা নয়। ঠিক যেমন নদী থেকে বেআইনি ভাবে বালি তুলে বিক্রি করা যায় না। কিন্তু, দুটোই সমান তালে চলেছে। প্রশ্ন হল, বালি চুরির দুর্নীতি যাঁরা দেখতে পান, তা নিয়ে প্রতিবাদ করেন, পুজোর সময় গণপরিসর দখল করে তার থেকে কতিপয়ের অর্থ উপার্জনের প্রক্রিয়াটি তাঁদের নজর এড়িয়ে যায় কেন? তার সম্ভাব্য উত্তর হল, বালিকে যত সহজে হরণযোগ্য সামূহিক সম্পদ হিসাবে চেনা যায়, রাস্তা অথবা আকাশকে তত সহজে আর্থিক সম্পদ হিসাবে চেনা যায় না। সে কারণেই এই দ্বিতীয় গোত্রের সম্পদ ব্যবহারে দুর্নীতির অনুভূতি ক্ষীণতর। আচরণবাদী অর্থশাস্ত্র একে চিহ্নিত করে ‘ফাজ় ফ্যাক্টর’ হিসাবে। অনুমান করা চলে, যাঁরা পুজোকে কেন্দ্র করে গণপরিসরের অধিকারবহির্ভূত আর্থিক ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত, তাঁরাও এর মধ্যে নিহিত ‘দুর্নীতি’কে স্পষ্ট ভাবে চিনতে পারেন না। পারলে কি এই কাজে তাঁরা বিরত থাকতেন?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy