ধর্মের নামে কোথায় পৌঁছেছি আমরা?” সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি কে এম জোসেফ ও হৃষীকেশ রায়ের বেঞ্চ এক মামলার আবেদনের শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন করল। উত্তরটি জানা। ধর্মের নামে ভারত পৌঁছেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কল্পিত হিন্দুরাষ্ট্রের দোরগোড়ায়, যেখানে ধর্ম ও রাষ্ট্র ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে অদ্বৈতে। ভারতের যে কোনও রাষ্ট্রীয় ধর্ম নেই, এই দেশ যে সব ধর্মের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হতে দায়বদ্ধ, জনমানস থেকে এ কথাটি কার্যত মুছে দিতে সক্ষম হয়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি। ফলে বিজেপির নেতা প্রকাশ্যেই মুসলমান ব্যবসায়ীদের গলা কাটার কথা বলেও পার পেয়ে যান; সমাজমাধ্যমে অবাধ ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুত্ববাদী নেতার বিদ্বেষভাষণ; গুলি করে মারার উস্কানি দিয়েও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় নেতার গুরুত্ব বাড়তে পারে। ভারত আজ সেখানে পৌঁছেছে, যেখানে গো-সন্ত্রাসকে নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হয়; সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পর প্রশাসনিক বুলডোজ়ার মুসলমানদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিলেও সমাজের চোখে তা অস্বাভাবিক ঠেকে না। ধর্মের নামে ভারত সেখানে পৌঁছেছে, যেখানে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের কারামুক্তিতে সাগ্রহ সম্মতি জানায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এই গৈরিক আধিপত্যের ভারতে আজ এ কথা প্রতিষ্ঠিত, রাষ্ট্রক্ষমতার চোখে মুসলমানরা নিতান্তই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক— সাভারকর, গোলওয়ালকরদের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সংবিধানের ৫১ক ধারার উল্লেখ করে দুই বিচারপতি আক্ষেপ করেছেন যে, ভারতে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলার কথা ছিল, এমন ধর্মীয় অন্ধত্ব নয়। সত্যিই, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি এই হিন্দুরাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রকল্পের অন্তর্নিহিত অন্যায় ও মধ্যযুগীয় মানসিকতা দেখতে পেতেন, তা হলে শাসকের সাধ্য ছিল না এই পথে হাঁটার। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুখে যা-ই বলা হোক না কেন, দেশকে আধুনিকতার পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে গোড়ায় গলদ থেকে গিয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। জওহরলাল নেহরুর পৌরোহিত্যে তৈরি হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রের মন্দিরস্বরূপ বাঁধ, কারখানা; তৈরি হয়েছে বিশ্বমানের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান— কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার প্রশ্নটি অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। ফলে, দেশের সিংহভাগ মানুষ— তাঁরা সাক্ষর হলেও— থেকে গিয়েছেন প্রকৃত শিক্ষার পরিধির বাইরেই; এবং তাঁদের নৈতিকতার বোধটি শিক্ষা দ্বারা নয়, চালিত হয়েছে কৌম মূল্যবোধ দ্বারা, যা বহু ক্ষেত্রেই প্রকৃত আধুনিক রাষ্ট্রের মননের পরিপন্থী। সেই মনগুলি যখন এমন নেতার সন্ধান পায়, যিনি নিজেও সঙ্কীর্ণতার যুক্তিতেই চালিত, তখন সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্র সেই পথে চলতে থাকে, ভারত আজ যে পথে ধাবমান।
ভারত আজ পরিচালিত খণ্ডিত সঙ্কীর্ণ মূল্যবোধ দ্বারা। ফলে, নাগরিকের যে মৌলিক অধিকারগুলি ভারতীয় সংবিধানের ভিত্তিপ্রস্তর, বারে বারেই সেগুলি বিস্মৃত হয় রাষ্ট্রশক্তি, জনসমাজও। বারে বারেই মনে করিয়ে দিতে হয়, ধর্ম বা জনগোষ্ঠীর এককে নয়, দেশের সংবিধান নাগরিককে স্বীকৃতি দিয়েছে ব্যক্তি-একক হিসাবেই, এবং কোনও জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার্থেই ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করা যায় না। সম্প্রতি দিল্লি হাই কোর্ট এক মামলায় জানাল, দুই প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক স্বেচ্ছায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে ধর্মীয় পরিচয় কোনও ভাবেই তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ধর্মীয় গোষ্ঠীগত পরিচয়ে নয়, নাগরিককে সংবিধান ব্যক্তি হিসাবে চেনে, স্বীকার করে বলেই আদালতের এই অবস্থান। সমাজের সে কথাটি জানা উচিত ছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও। কিন্তু কোনও পক্ষই যে কথাটি স্বীকার করে না, আদালতের মন্তব্যই তার প্রমাণ। ধর্মের নামে ভারত আজ যেখানে, সেখানে স্বঘোষিত গৈরিক ধ্বজাধারী ভিন্ন কারও অধিকারই আর সুরক্ষিত নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy