ফাইল চিত্র।
জনতার মতিগতি দেবতারও অজানা, মানুষ তো কোন ছার। ভোটের প্রচার এবং কোভিডের প্রসার পাল্লা দিয়া চলিতেছে, অথচ বহু মানুষ মুখমণ্ডল অনাবৃত রাখিয়া জনসমাগমে অম্লানবদনে বিচরণ করিতেছেন, ভাইরাসের সংক্রমণ হইতে অপরের নিরাপত্তা দূরস্থান, আপন নিরাপত্তা বিধান লইয়াও তাঁহাদের মাথাব্যথা নাই। ইহারই মধ্যে চৈত্র সেল। গত বৎসর নবাগত অতিমারির ধাক্কায় বর্ষশেষের উৎসব কেবল মার খায় নাই, বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। এক বৎসরে ভাইরাসের সহিত বিস্তর আলাপ-পরিচয় হইয়াছে, অতএব সংক্রমণের রেখা যে গতিতেই ঊর্ধ্বগামী হউক না কেন, কলিকাতার ক্রেতারা মুক্তকচ্ছ হইয়া সওদায় নামিয়াছেন। মুক্ত-মাস্ক বলিলেই যথাযথ হয়। নাকমুখ না ঢাকিয়া কেন ভিড়ের মধ্যে ঘুরিতেছেন— এই প্রশ্নের জবাবে তাঁহাদের কয়েক জনের বক্তব্য সম্প্রতি এই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। সেগুলি কেবল চমকপ্রদ নহে, রোমাঞ্চকর। আতঙ্কেও শরীরে রোমাঞ্চ জাগে বইকি! বস্তুত, মুখ খোলা রাখিবার যুক্তির কোনও অন্ত নাই। কেহ বলিয়াছেন, প্রচণ্ড গরমে রাস্তাই খুঁজিয়া পাইতেছেন না, তাহার উপর আবার মাস্ক! কাহারও আবার অনেকগুলি নূতন পোশাক কিনিয়া মনে খুব ফুর্তি হইয়াছে, মন ভাল থাকিলে মাস্কের কথা কি মনে থাকে? কেহ বা চুল বাঁধিবার ফিতা হারাইয়াছেন, তাই মাস্কের রশি দিয়া চুল বাঁধিয়া রাখিয়াছেন, অতএব মুখাবরণীকে কণ্ঠের উপরে তুলিবার উপায় নাই। শিশুক্রোড়ে এক পিতার মাস্ক গলায় নামিয়াছে, কারণ কন্যাটি বাবার মুখ ঢাকা দেখিলে ভয় পায়! দৃষ্টান্ত বাড়াইবার প্রয়োজন নাই, পরিস্থিতি বাস্তবিকই ‘গম্ভীর’।
অতিমারির প্রথম পর্বে তাহার সহিত লড়াইয়ের পথ লইয়া জনসমাজে যথেষ্ট ধারণার অভাব তো ছিলই, বহু বিভ্রান্তিও ছিল, নানা মুনির নানা মত সেই বিভ্রান্তি বহুগুণ বাড়াইয়া দিয়াছিল, বিশেষত মুনিরাও যখন অনেকেই কালক্রমে আপন মত বদলাইয়াছেন। মাস্ক পরিবার ভালমন্দ বিষয়ে গোড়ার দিকে খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দোলাচলের কথা বিশ্ববাসীর মনে আছে। নূতন সঙ্কটে এমন সমস্যা অস্বাভাবিক নহে। কিন্তু এক বৎসর পরে আজ পরিস্থিতি অনেকটাই বদলাইয়াছে। অনিশ্চয়তা এখনও আছে, বিভ্রান্তিও। কিন্তু অন্তত প্রাথমিক কর্তব্যগুলি সম্পর্কে কার্যত সকলেই একমত— প্রতিষেধক প্রয়োগের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিক নিয়মিত হাত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখিলে এবং জনসমক্ষে আপনার মাস্কটি যথাযথ ব্যবহার করিলে সংক্রমণ প্রতিরোধের সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়িয়া যায়। তাহা সত্ত্বেও যখন অগণিত নাগরিক বেমালুম অরক্ষিত অবস্থায় ঘুরিয়া নিজেকে ও অন্যদের বিপন্ন করিতে থাকেন, তদুপরি আপন বেপরোয়া আচরণের বিচিত্র হইতে বিচিত্রতর অজুহাত দেখাইতে থাকেন, তখন বুঝিতে হয়, এই সমাজে কাণ্ডজ্ঞান বস্তুটিই এখনও জন্মায় নাই, সামাজিক শুভচেতনা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
গভীর দুর্ভাগ্যের কারণ ইহাই যে, রাজনীতির নেতানেত্রীরাও সমাজকে দায়িত্বশীলতার অনুশীলনে নেতৃত্ব দিবার বদলে নিজেরা বহুলাংশেই সমাজের বেপরোয়া অংশটির অনুগামী। নির্বাচনী প্রচারের দীর্ঘ পর্বটিতে তাঁহাদের মাস্ক ব্যবহারে ঘোর অনীহাই প্রকট। প্রশ্ন করিলে তাঁহারা নানা যুক্তি দেখাইতেছেন, কেহ কেহ ‘দোষ স্বীকার’ করিতেছেন, কিন্তু প্রায় কাহারও আচরণে বা জবাবে প্রকৃত সচেতনতার প্রমাণ নাই। কোনও সন্দেহ নাই, সংক্রমণ প্রতিরোধের বিধিনিয়ম সম্পর্কে তাঁহাদের এই ঔদাসীন্য জনসাধারণের ঔদাসীন্যকে উৎসাহিত করিতেছে। পরিণাম ইতিমধ্যেই ভয়াবহ। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তাহা আরও অনেক বেশি ভয়াবহ হইয়া উঠিবার আশঙ্কা। নির্বাচন শেষ হইবে, কিন্তু কোন ধ্বংসাবশেষ সে পিছনে রাখিয়া যাইবে, রাজ্যবাসী জানেন না। বোধ করি, তাহা লইয়া ভাবিতেও চাহেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy