প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির গুণগান অবশ্য যাওয়ার নয়। প্রতীকী ছবি।
নারী দিবস চলে গেল। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির গুণগান অবশ্য যাওয়ার নয়। প্রশ্ন হল, সেই গুণগানের মধ্যে কোন প্রাচীন ভারতকে মনে করা হচ্ছে, কোন ভারতকে হচ্ছে না? এই যেমন, মনে কি রাখা হচ্ছে, মা দুর্গা, তারার দেশে কোথা থেকে আসত দেবীর উৎসব, যদি না থাকতেন অম্ভৃণী নামে এক নারী? ‘অহম্ রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।’ অম্ভৃণ ঋষির মেয়ে বাক বা অম্ভৃণী ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের এই ১২৫ নং সূক্তে জানাচ্ছেন, ‘আমি একাদশ রুদ্র, অষ্ট বসু, দ্বাদশ আদিত্য এবং বিশ্বদেবতারূপে বিচরণ করি।’ খুব আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ, সন্দেহ নেই। ঋগ্বেদের ঋষিরা মন থেকে মন্ত্র লিখতেন না। শাস্ত্রে বলে, তাঁরা মন্ত্রগুলি দেখতে পেতেন। এক কথায়, মন্ত্রদ্রষ্টা। তা হলে? নারী মন্ত্রদর্শনের অধিকারী নন, তিনি শুধু ঘরকন্না করবেন, পতিসেবা করবেন এবং সন্তানের জন্ম দেওয়াই তাঁর একমাত্র কর্তব্য— এ সব কথা ঋগ্বেদের ঋষিরা নিশ্চয় ভাবতেন না, দেখতেনও না। অম্ভৃণীর এই সূক্তই বেদে ‘দেবীসূক্ত’ নামে খ্যাত, চণ্ডীপাঠ করলে এই সূক্ত অবশ্যই পড়তে হবে। এমনকি রেডিয়ো যুগের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটিও ব্যত্যয় নয়, সেখানে ফি বছর শোনা যায় এই মন্ত্র। বেদ থেকে বেতার, যুগে যুগে নারীর আত্মদৃপ্ত এই উচ্চারণেই সনাতন হিন্দুর ঐতিহ্য। পণপ্রথা, হাথরস, উন্নাওয়ের মন্দিরে ধর্ষণ থেকে মহিলাদের ‘সংস্কারী’ হওয়ার হিন্দুত্ববাদী নিদানের সঙ্গে বরং বৈদিক ধর্মের কোনও যোগ নেই। বিষয়সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের স্ত্রী মৈত্রেয়ীর স্পর্ধিত উচ্চারণ ‘যেনাহং নামৃতা স্যাম্ তেনাহং কিং কুর্যাম্’, মানে, যাতে মৃত্যু থেকে উত্তরণের অমৃত পাব না, সেই নশ্বর বিষয়আশয় নিয়ে কী করব, সেটি তো এই দেশে ব্রহ্মবাদী দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্থানবাক্য। হিন্দুত্বের ঝাঁঝালো আরক ভুলিয়ে দিয়েছে, এই দেশে দেবীপুজো থেকে দর্শনশাস্ত্র, সর্বত্র নারীর চিন্তাভাবনা ও স্বকীয়তার উজ্জ্বল উদ্ধার।
ভ্রান্তিবিলাসে আচ্ছন্ন হয়ে নারীকে এ ভাবে বশ মানানো কবে থেকে? মুসলমান আক্রমণে মেয়েরা সকলে ধর্মরক্ষার্থে অন্দরমহলে ঢুকে গেল, জহরব্রতের আগুনে ঝাঁপ দিল এই সব কাহিনিতে কল্পনা এবং গালগল্প যত আছে, সত্য তার সিকি ভাগও নেই। আলাউদ্দিন খিলজির আক্রমণে সিনেমার পদ্মাবত বা চিতোরের রানি পদ্মিনীর আগুনে ঝাঁপ দেওয়াটা খিলজি শাসনের বহু পরে মালিক মুহম্মদ জয়সি নামে এক কবির কল্পনা। তিনি ওই কাব্য না লিখলে, মেবার, চিতোর, জয়পুরের রাজাদের চারণকবিরা ওই ভাবে নিজেদের রানিদের গৌরবগাথা গাইতেন না, পরবর্তী কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেমস টড নামে এক সৈনিক সেটি খুঁজে পেতেন না। ওই টডের কাহিনি থেকেই তো আমাদের জাতীয়তাবাদের ‘রাজকাহিনী’। মেয়েদের অন্দরমহলে অবরুদ্ধ করে রাখার ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই মূলত কবিকল্পনা।
‘শকুন্তলা’ এই কল্পনার স্পষ্ট উদাহরণ। মহাভারতের শকুন্তলা স্বাধীন, বিদ্রোহী এবং স্পষ্টভাষিণী। তপোবন থেকে ছেলে ভরতকে নিয়ে তিনি দুষ্যন্তের রাজসভায় হাজির হন। কণ্ব মুনির আশ্রমে গান্ধর্ব বিয়ের ফল ছেলেকে রাজা গ্রহণ করতে চান না: “দুষ্টা তাপসী, ভুলভাল বকছিস!” শকুন্তলাও ছাড়ার পাত্রী নন: “প্রাণিজগতে পিঁপড়েও নিজের ডিম সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আর তুই ধর্মজ্ঞ হয়েও নিজের ছেলেকে স্বীকার করছিস না!” অন্দরমহলে নয়, রাজসভায় বল্কল-পরিহিতা এক অচেনা তরুণীর সঙ্গে সিংহাসনারূঢ় নৃপতির তুইতোকারি ঝগড়া। পরে গুপ্তযুগে মহাভারতের এই স্বাধীনচেতা নারী হারিয়ে গেলেন। ব্যাসদেবের কল্পনায় যা ছিল না, রাজসভার কবি কালিদাস সেই আংটির অভিজ্ঞান নিয়ে এলেন তাঁর নাটকে। দুষ্যন্ত আদৌ খলচরিত্র নন, দুর্বাসা মুনির অভিশাপে ভুলে গিয়েছেন সব। আর বেচারি শকুন্তলা দুষ্যন্তদত্ত আংটি হারিয়ে ফেলেছে। কালিদাস, বিক্রমাদিত্যদের এই গুপ্তযুগটিই ভারতীয় ইতিহাসে হিন্দুর স্বর্ণযুগ। তখন ক্ষমতাবান সম্রাটের দোষ নেই, তেজস্বিনী তাপসী তত দিনে আংটি হারানো, সলজ্জ, ভয়ার্ত তরুণীতে রূপান্তরিত। হিন্দুত্ববাদ যদি হিন্দুর প্রকৃত উত্তরাধিকারের কথা ভাবে, তা হলে মাঝপথে গুপ্তযুগে এই ভাবে না ফিরে বরং বেদ-বেদান্ত, ব্যাস, বাল্মীকিতে ফিরুক। কিন্তু সেটি পরিশ্রমসাধ্য, প্রকীর্ণ জ্ঞানকাণ্ড। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, শ্রীচৈতন্য, স্বামী বিবেকানন্দের পথ। ‘গরব সে কহো হম হিন্দু হ্যাঁয়’ গোছের রাজনৈতিক চিৎকার অত দূর পৌঁছয় না, ভোটের রাজনীতিতে সেই সাধ বা সাধ্য কোনওটাই তার নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy