Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

অমৃতসমান

চাপে পড়িয়াই নরেন্দ্র মোদী তাঁহার প্রাথমিক উক্তির একটি ব্যাখ্যা খাড়া করিলেন না তো? রাজনীতিতে এমন ‘ব্যাখ্যা’ বহুলপরিচিত বইকি।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৫:৩৮
Share: Save:

রাজ্যসভায় গুহ্যসূত্রটি উচ্চারিত হইয়াছিল, লোকসভায় তাহার মহাভাষ্য মিলিল। কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গে সোমবার নরেন্দ্র মোদী ‘আন্দোলনজীবী’দের মুণ্ডপাত করিয়াছিলেন, বুধবার জানাইলেন— অভিধাটি কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নহে, যাহারা সেই আন্দোলনের অপব্যবহার করিয়া তাহাকে ‘অপবিত্র’ করিতেছে তাহাদের সম্পর্কে! এমন চমৎকার ব্যাখ্যান তৈরি করিতে দুই দিন সময় লাগিল কেন, দুষ্ট লোকে প্রশ্ন করিতে পারে। ভক্তরা জবাবে বলিবেন, মহামান্য প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের নূতন শাস্ত্র শুনাইতেছেন, এমন মহতী সৃষ্টিলীলা সম্পাদনে কল্পকল্পান্তর কাটিয়া যাইতে পারে, দুই দিন তো মুহূর্তমাত্র। সত্য বটে। তবে কিনা, ইতিমধ্যে তাঁহার উক্তিটি লইয়া অনেক আলোড়ন হইয়াছে, বিস্তর সমালোচনা ও নিন্দা শোনা গিয়াছে। চাপে পড়িয়াই নরেন্দ্র মোদী তাঁহার প্রাথমিক উক্তির একটি ব্যাখ্যা খাড়া করিলেন না তো? রাজনীতিতে এমন ‘ব্যাখ্যা’ বহুলপরিচিত বইকি।

ভাষ্যরচনার গূঢ় বৃত্তান্ত যাহাই হউক না কেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী সংসদের কক্ষে দাঁড়াইয়া প্রতিপক্ষকে আন্দোলনজীবী (এবং পরজীবী) বলিয়া ব্যঙ্গ করিতেছেন— এই দৃশ্য তাঁহার পক্ষে এবং তাঁহার দেশের পক্ষে লজ্জার, সেই লজ্জার বোধ তাঁহার থাকুক বা না থাকুক। অগণিত নাগরিক আড়াই মাস ধরিয়া প্রতিকূল আবহাওয়া এবং প্রতিকূল রাষ্ট্রশক্তির বিবিধ আক্রমণ সহ্য করিয়া যে আন্দোলন চালাইতেছেন, যে আন্দোলন বহু প্ররোচনা সত্ত্বেও সংযত থাকিয়া গোটা পৃথিবীর সম্ভ্রম আদায় করিয়াছে, যে আন্দোলনের পরিসরে ইতিমধ্যে বহু মানুষের প্রাণ গিয়াছে, তাহার প্রসঙ্গে এমন ব্যঙ্গোক্তি কোনও সুস্থরুচির সভ্য নাগরিককেই মানায় না, প্রধানমন্ত্রীকে তো নহেই— বিশেষ করিয়া সেই আন্দোলনের প্রতি, প্রতিবাদী কৃষকদের প্রতি যে প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতির তিলমাত্র পরিচয়ও পাওয়া যায় নাই। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলিতেছেন, কৃষক আন্দোলনকে তিনি ‘পবিত্র’ মনে করেন। গত আড়াই মাস ধরিয়া এই আন্দোলনের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ স্মরণ করিলে বলিতেই হয়, তাঁহাদের অভিধানে পবিত্রতার অর্থ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।

প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক ব্যঙ্গ এবং তাঁহার পরবর্তী ভাষ্য— দুই-ই সঙ্কেত দেয় যে, কৃষক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি দেখিয়া তাঁহারা দুশ্চিন্তায় পড়িয়াছেন এবং সেই দুশ্চিন্তা তাঁহাদের ক্রোধ উৎপাদন করিতেছে। এমন প্রতিক্রিয়া গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। সরকারি নীতি ও কর্মপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ বিক্ষোভ আন্দোলন হইবে, একটি আন্দোলন এক পরিসরে এক ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর দাবিতে শুরু হইয়া ক্রমে বিস্তৃত হইবে— গণতন্ত্রে ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। বস্তুত, দেশের বর্তমান শাসকদের অন্যায় এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন হইবার কথা ছিল, বাস্তবে তাহার সিকিভাগও হয় নাই। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রবল নিষ্পেষণ ও ভীতিপ্রদর্শন এবং বিরোধীদের দুর্বলতাই তাহার জন্য দায়ী। আজ সেই ভয় এবং জড়তা কিছুটা কাটিবার লক্ষণ দেখা দিয়াছে, প্রতিবাদের স্বরগুলি ক্রমে জাগ্রত হইতেছে। কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা এই পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। এই কারণেই কি শাসক এমন ক্ষিপ্ত? লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, হাজতে বন্দি নকশালবাদী, সন্ত্রাসবাদীদের ছবি বুকে লাগাইয়া যাঁহারা কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে কথা বলিতেছেন, তাঁহাদেরই তিনি আন্দোলনজীবী আখ্যা দিয়াছেন। ইহাই সেই মানসিকতার কণ্ঠস্বর, যাহা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রতিবাদকে দেশদ্রোহ বলিয়া মনে করে, সুতরাং সরকার-বিরোধী যে কোনও আন্দোলনই তাহার বিচারে দেশবিরোধী বলিয়া গণ্য হয়। নরেন্দ্র মোদীর বিদ্রুপ এবং তাহার অন্তর্নিহিত ক্রোধ এই মানসিকতার সন্তান। তাঁহার ভাষায়, মন কি বাত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy