ফাইল চিত্র।
ভোটের প্রাণ, গড়ের মাঠ। এক নারীর ব্যান্ডেজ-আবৃত পদ বলটিকে সেই মাঠের বাহিরে পাঠাইয়া দিল, বলের সহিত প্রতিপক্ষের রথী-মহারথীরাও— ভ্যানিশ! নির্বাচনের ফল প্রকাশের আগেই ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হইয়া গিয়াছিল। নেট মাধ্যমে ভোটের মরসুমে অজস্র কার্টুন ও মিম ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। কোথাও হীরক রাজার আদলে ‘দড়ি’ ধরিয়া টান মারিবার আহ্বান, কোথাও বা রোমক সৈন্যদের আক্রমণেও অ্যাসটেরিক্সদের ছোট গ্রামটির অপরাজেয় থাকিবার কথা, কোথাও বা দাড়ি-সহ পরিচিত রামছাগলের ছবির সহিত সুকুমার-বচন: ‘পাঁড়েজির ছাগলের এক হাত দাড়ি, অপরূপ রূপ তার যাই বলিহারি।’ সব মিমই যে শিল্পিত রুচির, এমত নহে। কিন্তু এই হট্টমালাও সংস্কৃতির প্রবল উদ্ধার। সুকুমার রায়, পরশুরাম, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়দের দেশে এ বারের ভোটপর্বে কৌতুক ফিরিয়া আসিল মহাসমারোহে। বাঙালির ভোট-কৌতুক আজিকার নহে। জঙ্গিপুরের দাদাঠাকুর গান বাঁধিয়াছিলেন, ‘ভোট দিয়ে যা, আয় ভোটার আয়, মাছ কুটলে মুড়ো দিব, গাই বিয়োলে দুধ দিব...।’ এমন প্রজ্ঞায় জারিত বঙ্গবাসীর অন্তরে ‘সোনার বাংলা’ গড়িবার প্রতিশ্রুতি যদি হাস্যোদ্রেক করিয়া থাকে, বিস্ময়ের কিছু নাই। অন্য রাজ্য ভয়ে-ভক্তিতে হনুমান চালিশা পাঠ করিতে পারে, জয় শ্রীরাম হুঙ্কার দিতে পারে। কিন্তু, কৃত্তিবাস ওঝার কাল হইতে বাঙালি জানে, বালির পুত্র অঙ্গদ লঙ্কাপুরীতে রাবণের মস্তক হইতে রাজমুকুট ছিনাইয়া লইবে। অতঃপর পরাক্রমী লঙ্কাধিপের আর্তনাদ, ‘...সবে, আছ কোন কাজে। বানরে মুকুট লয় সবাকার মাঝে।’ বাঙালি কবি রাম-রাবণের যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও কৌতুক-আবহ সৃষ্টি করেন, ক্ষুদ্র বানরে পরাক্রান্ত দশাননের রাজমুকুট ছিনাইয়া লয়।
আজিকার অজানা, অচেনা শিল্পীদের মিম এবং কার্টুন রচনাতে কেবল পরিহাস নাই, আছে ‘কার্নিভাল’-এর রাজনীতিও। মধ্যযুগের ইউরোপে কার্নিভালের দিন সকলে রাজা ও যাজকদের বিরুদ্ধে ছড়ার গান বাঁধিত, অমার্জিত অঙ্গভঙ্গিতে উল্লাস প্রকাশ করিত। কার্নিভাল তত্ত্বের প্রবক্তা মিখাইল বাখতিন বলিয়াছিলেন, সরকারি ক্ষমতা-কাঠামো উৎসবে প্রতিষ্ঠিত সত্যটিকে প্রমাণিত করিতে চাহে, কার্নিভাল তাহার বিরুদ্ধে সহাস্য ভঙ্গিতে পরিবর্তন ও নূতন সত্যের কথা বলে। সরকারি ক্ষমতায় লোকপ্রজ্ঞা থাকে না, কার্নিভালে লোককাহিনি, লোক-উৎসব নূতন শক্তিতে সিঞ্চিত হয়। ভোট-প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর ‘দিদি, ও দিদি’ ডাকের বিরুদ্ধে কেন হীরক রাজা, অ্যাসটেরিক্সরা উঠিয়া আসেন, তাহার উত্তর নিহিত আছে এই কার্নিভাল মনোভঙ্গিতেই। বাখতিন বলিয়াছিলেন, সরকারি নাটকে পাদপ্রদীপ থাকে, জনতার কার্নিভালে থাকে না। পূর্বে বেশির ভাগ সংবাদপত্র কার্টুন ছাপিত, সেই কার্টুনের নীচে শিল্পীদের নাম থাকিত। তাহা এখন পুরাতন ইতিহাস। সমাজমাধ্যমে ক্ষমতার বিরোধী কার্নিভাল সেই শূন্য পরিসরের জন্য হাহুতাশ করিয়া বসে থাকে নাই, তাহাকে পুরাতনের আলোকে নবকলেবরে সাজাইয়া লইয়াছে। যে দেশের পরাক্রান্ত নেতা ভয়ঙ্কর অতিমারির পরিস্থিতিতে ঔষধ, অক্সিজেনের অভাবে মানুষের আর্তনাদকে পাত্তা না দিয়া সেন্ট্রাল ভিস্টা নির্মাণ করেন, সেই দেশে সরকারি টিকা উৎসব নহে, আমজনতার পরিহাস ও ব্যঙ্গমুখর কার্নিভালই ভবিতব্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy