Advertisement
E-Paper

শিরোপার গ্লানি

জনস্মৃতিপটে জাজ্বল্যমান গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের বীভৎস চেহারা। মনোনয়ন পর্ব থেকেই শুরু হয়ে যায় সেই বোমাবাজি ও ভয় দেখানোর বীভৎসতা।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২৪ ০৭:৩১
Share
Save

একটি বিষয় সোজাসুজি স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, অধুনা নির্বাচন সামনে এলেই সমগ্র দেশ কেন, এমনকি বহির্বিশ্বেরও বিশেষ নজর কেড়ে নেয়— পশ্চিমবঙ্গ। ভোট-সংক্রান্ত হিংসা ও অশান্তির পরিমাণে এই রাজ্য দেশের মধ্যে কেবল প্রথম নয়, প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এর কার্যকারণ আলোচনাসাপেক্ষ, কিন্তু রাজ্যের রাজনৈতিক সমাজের একাংশে যে এখনও এমন কথাকে মনে করা হয় কুৎসা ও অপপ্রচার, সেটা কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া আর কিছু নয়। জেনে রাখা ভাল, আন্তর্জাতিক সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান মঞ্চে এখন ‘পশ্চিমবঙ্গের হিংসা’ আলাদা ‘কেস-স্টাডি’র বিষয়, একটি তুলনা-রহিত দৃষ্টান্ত। প্রথমে এই ‘গৌরব’ময় শিরোপা মাথায় তুলে নিয়ে তবেই পরবর্তী আলোচনায় যাওয়া সাজে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন রাজ্যে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে যে বার্তা দিয়ে গেল, তাতে তাই কোনও ভাবেই ‘অভিসন্ধি’ দেখা বা খোঁজা যাবে না। মেনে নিতে হবে, এইটাই এ রাজ্যের বাস্তব, এবং/সুতরাং এই বাস্তব চলমান রাখায় বর্তমান প্রশাসনেরই দায় ও দায়িত্ব সর্বাধিক।

জনস্মৃতিপটে জাজ্বল্যমান গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের বীভৎস চেহারা। মনোনয়ন পর্ব থেকেই শুরু হয়ে যায় সেই বোমাবাজি ও ভয় দেখানোর বীভৎসতা। বিরোধী দলগুলি হাই কোর্টে অভিযোগ জানানোয় আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদে পরিস্থিতি সন্ত্রাসের পর্যায়ে চলে যায়। ২০১৮ সালেও একই ঘটনা ঘটেছিল, ২০২১ সালের বিধানসভাতেও ন্যূনাধিক ততটাই। গণতন্ত্রের সমস্ত চিহ্ন লোপাট করে যে সন্ত্রাসতন্ত্র ভোটের সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বুকে রাজপাট চালায়— প্রশাসনের অনবধানে তা ঘটছে, এ কথা বলা অসম্ভব। আর প্রশাসনের প্রশ্রয়ে তা ঘটছে, এ কথা স্বীকার করার মধ্যে অসহায়তার সঙ্গে মিশে থাকে তুমুল গ্লানি। বাইরের রাজ্য ও দেশগুলির ভোটের সময়ে সামনে পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন, এমন নাগরিকের সংখ্যা বিরাট।

এ দিকে সমাজবিদ্যার আলোচনাতে উঠে আসে আরও একটি তথ্য: ভোট ছাড়া অন্য সময়ে এ রাজ্যে হিংসার পরিমাণ অনেক রাজ্যের তুলনায় কম। ছবিটি সাধারণ বোধের অগম্য নয়। কেননা এই সংঘর্ষ-প্রবণতা আসলে গভীর ভাবে যুক্ত ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনার সঙ্গে, যা আবার গভীর ভাবে যুক্ত অর্থনৈতিক সম্পদ-লুণ্ঠনের নকশাটির সঙ্গে। তাই রাজনৈতিক জয়লাভ করা ও না করার মধ্যে আছে এক বিপুল ফারাক, যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে এ রাজ্যে। সঙ্গে বেড়ে চলেছে অস্ত্রের জোগান, স্থানীয় দুর্বৃত্তায়ন, এবং সেই দুর্বৃত্ত-বলয়ের পিছনে প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয়দান। প্রশ্ন হল, এই সমগ্র বাস্তব কি তৃণমূল জমানারই নির্মাণ? সন্দেহ নেই, গত ছয় দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে হিংসার বিপুলতা ও ব্যাপকতা যথেষ্ট ভাবে দেখা গিয়েছে, বাম-পূর্ব, বাম, বাম-উত্তর, সব শাসনেই। বাম ক্যাডারবাহিনীর ভোট-হিংসার উত্তরাধিকারের অভ্রান্ত ছাপ তৃণমূলের সংগঠনে, কর্মপদ্ধতিতে। কিন্তু তার সঙ্গেই স্বীকার্য, তৃণমূল শাসনের বিকেন্দ্রিত চেহারা ও লাগামহীন দুর্বৃত্তনির্ভরতা সম্পূর্ণ একটি আলাদা মাত্রায় নিয়ে চলেছে গোটা ঘটনাটিকে। তৎসঙ্গে, বাম আমলে বিরোধীরা যতটা এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দলীয় স্বার্থ মিটিয়েছে, আজ তৃণমূল আমলে প্রধান বিরোধী বিজেপি তার চেয়েও সুপরিকল্পিত ভাবে সে কাজ করে চলেছে, সন্ত্রাসে পূর্ণমাত্রায় অবগাহন করছে। একা সন্দেশখালিই রাজ্যের মডেলটিকে স্পষ্ট করে দেখাতে যথেষ্ট। এমতাবস্থায়, আগামী তিন মাসের জন্য এই রাজ্যের নেতৃসমাজ ও নাগরিক সমাজের প্রতি বার্তা হতে পারে একটিই: ভোট নামক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিটিকে হত্যা-অত্যাচার, নির্যাতন-নিষ্পেষণের প্রকরণ হিসাবে দেখা বন্ধ হোক। রাজ্যের মাথা সর্বসমক্ষে হেঁট হয়েই আছে। এই অবমাননা আরও গভীরতর, প্রবলতর না হয়ে উঠুক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Political Violence Post Poll Violence Election Lok Sabha Election 2024 West Bengal

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}