Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Chimpanzee Vanilla

অমৃতের স্বাদ

প্রাণীর অধিকার হরণের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেন, এমন একটি সংগঠন অনেক দিন ধরেই ওই গবেষণাগারে রাখা জীবদের দুরবস্থা নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন।

Vanilla the chimpanzee, caged for entire life, sees sky for first time.

শিম্পাঞ্জি ভ্যানিলা। ছবি: সংগৃহীত।

শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৩ ০৪:৫৩
Share: Save:

মেয়েটির নাম ভ্যানিলা। তার বয়স ঊনত্রিশ। এ-যাবৎ কোনও দিন আকাশ দেখেনি সে। দেখবে কী করে? জন্ম থেকেই মানবকল্যাণে নিবেদিত হয়েছিল আমেরিকা-নিবাসী শিম্পাঞ্জি-কন্যাটি। চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণার জন্য তার দেহের উপরে এত দিন রকমারি পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়েছে। খাঁচার ভিতরেই তার অষ্টপ্রহর বসবাস ছিল, বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। প্রাণীর অধিকার হরণের বিরুদ্ধে যাঁরা লড়াই করেন, এমন একটি সংগঠন অনেক দিন ধরেই ওই গবেষণাগারে রাখা জীবদের দুরবস্থা নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত কিছুটা প্রতিকার হয়েছে, বন্দিরা ওই খোঁয়াড় থেকে বেরোতে পেরেছে। সেই সূত্রেই ভ্যানিলার স্থান হয়েছে এক অভয়ারণ্যে। সেখানে স্বজাতির আরও জনাকয়েক বাসিন্দার সঙ্গে থাকবে সে। সংগঠনের কর্মীরা তার একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিয়ো-চিত্র সমাজমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সে এক আশ্চর্য দৃশ্য। নতুন আবাসে এসে মেয়েটি প্রথমে ঈষৎ তটস্থ, তার পরেই সেই আবাসের এক পুরুষ তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়, মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ে তার দুই প্রসারিত বাহুর আশ্রয়ে, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে একটু দাঁড়ায়, অতঃপর আপন মনে এগিয়ে চলে সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে। এগিয়ে যাওয়ার আগে এক বার আকাশের দিকে তাকায় সে, তার আকাশ-দেখা চোখে অপার বিস্ময়। এবং তার ওই অবাক-হয়ে-যাওয়া মুখটি নিজেই হয়ে ওঠে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্যকণা, যা দেখে আকাশ মুগ্ধ হয়ে যায়, সেই মুগ্ধবোধের বার্তা নিয়ে আসে বাতাস, মৃদুস্বরে বলে ওঠে: একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি।

অলস কল্পনা? হবে। অসার আবেগ? হবেও বা। তবু ওই মুহূর্তটি হয়তো বহু মানুষের মনের কোণে থেকে যাবে। ডিজিটাল পরিসরে যে অগণন দর্শক চলৎ-চিত্রটি দেখেছেন তাঁদের অনেকেরই হঠাৎ কখনও মনে পড়বে বিস্মিত ভ্যানিলার চোখ দু’টি। কেউ বা আপন অনুভূতিতে সেই বিস্ময়ের অনুরণন খুঁজবেন। হয়তো পাবেন, হয়তো পাবেন না। ফ্লরিডার অভয়ারণ্যে ওই তরুণ প্রাণীটি সেই আনন্দ পেয়েছে, কারণ সে এই প্রথম আকাশের নীচে দাঁড়ানোর সুযোগ পেল। তার বন্দিত্বের অভিজ্ঞতা তাকে মুক্তির প্রগাঢ় অর্থ বুঝিয়ে দিতে পেরেছে, সেই বোধের মধ্য দিয়েই এক অর্থে তার দীর্ঘ যন্ত্রণার আংশিক এবং সামান্য ক্ষতিপূরণ হয়েছে। কিন্তু বন্দি না হয়েও, বাইরের বাধা না থাকা সত্ত্বেও যে মানুষ আকাশ দেখার চোখ হারিয়ে ফেলেছেন, তাঁর সেই আন্তরিক ক্ষয় কি অপূরণীয় নয়? তাঁকে অনন্ত প্রকৃতির সামনে অবাধ মুক্তি দিলেও যদি তিনি সেই মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন, সেই বঞ্চনা তো বাইরের নয়, অন্তরের। সেই কারণেই তা খুব বড় দুর্ভাগ্যের কারণ। আরও বড় দুর্ভাগ্য, যদি অভাববোধটুকুও তাঁর না থাকে, কী হারিয়েছেন তা-ও যদি তিনি না জানেন। ‘মনুষ্যেতর’ প্রাণীর ওই বিস্ময়বোধ যে সে-বোধে বঞ্চিত মানুষের অতি বড় ঐশ্বর্যের থেকে অনেক বড় সম্পদ— এই সত্যও তাঁর কাছে অর্থহীন। দুর্ভাগ্য বইকি।

ভয় হয়, এই পৃথিবীর বহু মানুষই সেই দুর্ভাগ্যের শরিক। খোলা আকাশ দেখার অনাবিল আনন্দ উপলব্ধির সামর্থ্য তাঁদের নাগালের বাইরে। নিরুপায়ের জীবনযন্ত্রণা যাঁদের সেই সামর্থ্য হরণ করেছে তাঁদের কথা অন্যত্র। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে সক্ষম, স্বাভাবিক, এমনকি সমৃদ্ধ অনেক নাগরিকও আজ আর প্রকৃতির মধ্যে কোনও বিস্ময় খুঁজে পান না। তার অনেক কারণ, অনেক ব্যাখ্যা। তবে একটি বড় কারণ অবশ্যই বিনোদনের প্রযুক্তিতে অভূতপূর্ব ‘উন্নতি’, যার কল্যাণে দুনিয়া জুড়ে সমাজের বিভিন্ন বর্গে, কার্যত সমস্ত স্তরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় অজস্র সহস্রবিধ রসদের অন্তহীন স্রোত বয়ে চলেছে। তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে নবীন প্রজন্মের উপরে, যারা এখন প্রায় আক্ষরিক অর্থেই জ্ঞান হওয়ার মুহূর্ত থেকে এই প্রযুক্তির নিত্যসঙ্গী। তার পরিণাম অহরহ প্রকট। শহর ছেড়ে দু’দণ্ড বেড়াতে যাওয়া শিশুর চোখের সামনে প্রকৃতির অফুরন্ত সম্ভার, কিন্তু তার একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে মোবাইল টেলিফোন নামক আশ্চর্য প্রদীপটিতে— এমন দৃশ্য আজ বিরল নয়, বরং অত্যন্ত সুলভ। মোবাইল একটি প্রকরণমাত্র, কিন্তু সে এক জীবনধারার প্রতীকও বটে। সেই জীবনধারায় মানুষ তার নিজের প্রতিবেশের সঙ্গে সংযোগ হারিয়েছে। জীবনে প্রথম বার সেই সংযোগের উপলব্ধিই ভ্যানিলার দৃষ্টিতে অপার্থিব আনন্দ এনে দিয়েছিল। আমরা— পৃথিবীর ‘শ্রেষ্ঠ’ প্রাণীরা— সেই অমৃতের স্বাদ ফিরে পেতে চাইব কি না, তা আমাদেরই বিচার্য।

অন্য বিষয়গুলি:

life Environment Nature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE