তৃণমূল নেতাদের প্রকাশ করা ভিডিয়ো থেকে নেওয়া ছবি। যাচাই করেনি আনন্দবাজার অনলাইন। ছবি: সংগৃহীত।
রামনবমী মানেই রাজ্য জুড়ে অশান্তি, এত দিনে এটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ বছরও মিছিলকে কেন্দ্র করে তৈরি হল বিপুল অশান্তি, যার রেশ এখনও থামেনি। রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার গুরুদায়িত্ব অবশ্যই সরকার এবং প্রশাসনের উপরে ন্যস্ত— রাজধর্ম পালন করতে প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু, রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার যা ঘটল, তার দায় বিরোধী দলকেও গ্রহণ করতে হবে। অনুমান করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, প্রতি বছরই এই মিছিলের অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন। এবং, প্রতি বছরই সেই প্রদর্শনীর সুর চড়ে। অভিযোগ উঠেছে যে, হাওড়ায় পূর্বনির্দিষ্ট অনুমোদিত যাত্রাপথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মিছিল গিয়েছিল সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকায়। কেন, তার কারণটি অনুমান করা সম্ভব। এবং, এই প্রবণতাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা মিছিলের সাময়িক উত্তেজনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। একই দিনে দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী অঞ্চলে বিপুল মিছিল বার হয়েছিল। অঞ্চলটি তাৎপর্যপূর্ণ— ২০২০ সালে দিল্লির গোষ্ঠী-হিংসার সূচনা হয়েছিল এই এলাকা থেকেই। শুধু দিল্লি বা হাওড়াই নয়, রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে অশান্তি তৈরি হয়েছে মহারাষ্ট্রের একাধিক অঞ্চলে, গুজরাতের বরোদায়। কেউ অনুমান করতেই পারেন যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রামনবমীর মিছিলকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরির পিছনে একটি সুনির্দিষ্ট নকশা রয়েছে। হাওড়ার অশান্তিকে এই বৃহত্তর ছবিটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি।
ভারতের ইতিহাস সাক্ষী, এ দেশে ধর্মীয় মিছিল থেকে যত অশান্তি, যত রক্তক্ষয়ের সূত্রপাত হয়েছে, তা প্রায় তুলনাহীন। ঔপনিবেশিক আমলের ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও ধর্মীয় মিছিল থেকে অশান্তির প্ররোচনার উল্লেখ ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এমন অশান্তির উদাহরণ বিস্তর। এবং অভিজ্ঞতা বলবে যে, অশান্তি কখনও আপনা থেকে তৈরি হয় না— তার পিছনে কাজ করে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, সুস্পষ্ট ছক। পশ্চিমবঙ্গে রামনবমীর মিছিলকে প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের উপলক্ষ করে তোলার মধ্যেও তেমন ছকের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। মনে রাখা জরুরি যে, রামনবমীতে এ-হেন অস্ত্রমিছিল কোনও কালেই বাংলার ঐতিহ্য ছিল না। বাংলার সংস্কৃতি রামকে চেনে ভিন্ন ভাবে। বৃহস্পতিবারের মিছিলে ডিজে বক্সে তারস্বরে বাজতে থাকা হিন্দি গান, গৈরিক পতাকায় আঁকা ক্রুদ্ধ পবনপুত্রের ছবি, কোনওটিকেই বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি বলে চালানো মুশকিল। অনুমান করা চলে যে, বহিরাগত সংস্কৃতির এই প্রকাশ্য দাপট আসলে বার্তাবাহী— বাংলার মাটিতে এই বাহিনীর বাহুবল কতখানি বৃদ্ধি পেয়েছে, তা দেখিয়ে দেওয়ার পথ। শক্তি প্রয়োজন হয় বিরোধের জন্যই। অতএব, সেই মিছিল বিরোধের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করে নেয়।
এখানেই রাজ্য প্রশাসনকে কিছু প্রশ্ন করা জরুরি। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় যেখানে দেখা গিয়েছে যে, রামনবমীর মিছিল আসলে গৈরিক বাহুবলীদের শক্তির প্রদর্শনীমাত্র, সেখানে প্রশাসন আরও সতর্ক হবে না কেন? রামনবমীর মিছিলের সঙ্গে অস্ত্রের সম্পর্ক কী, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, সেই সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, তা হলেও সেই অস্ত্রকে বাধ্যতামূূলক ভাবে প্রতীকী হতে হয়। ধারালো তরবারি-সহ যে পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে মিছিল হয়, কোনও প্রশাসনের পক্ষেই কি তাকে ছাড়পত্র দেওয়া সম্ভব? গত বছরগুলিতেও অস্ত্রের এমনই ঝনঝনানি শোনা গিয়েছে মিছিলে। অস্ত্র নিষিদ্ধ করার কথাও শুনিয়েছে প্রশাসন। অস্ত্র তো হাওয়া থেকে নেমে আসে না— মিছিল উপলক্ষে অস্ত্র জড়ো করা হচ্ছে, পুলিশের কাছে সেই খবরও থাকা উচিত ছিল। পুলিশ-প্রশাসন কোনও রকম সাম্প্রদায়িক উস্কানি সহ্য করবে না, আইনশৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় আপস করবে না, বিদ্বেষের রাজনীতির কারবারিদের এ কথাটি বুঝিয়ে বলা প্রয়োজন ছিল। পুলিশ পারেনি। বিদ্বেষের জয় হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy