Advertisement
E-Paper

যা গেছে তা যাক?

ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে সম্মিলিত বিশ্বাসের ভিতের উপর। অবাধ ঋণখেলাপির সুযোগ সেই বিশ্বাসের একেবারে গোড়ায় আঘাত করে।

debt.

—প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২৩ ০৬:০২
Share
Save

অনাদায়ি ঋণের বোঝা লাঘবের সহজতম উপায়টি কী, ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্র তা আবিষ্কার করে ফেলেছে— উপায় হল, ব্যাঙ্কের খাতা থেকে সেই অনাদায়ি ঋণটিকেই মুছে দেওয়া। ‘যাক যা গেছে তা যাক’, মহামন্ত্র সম্ভবত এটাই। এই মহামন্ত্রেই গত দশ বছরে ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে গিয়েছে তেরো লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অনাদায়ি ঋণ। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক কিছু দিন আগে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়েছিল যে, ইচ্ছাকৃত ভাবে ঋণখেলাপি করেছেন যাঁরা— অর্থাৎ, আর্থিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ করেননি, বা শোধ না করার উদ্দেশ্য নিয়েই ঋণ করেছেন, এক কথায় যাঁরা ঋণের নামে জালিয়াতি করেছেন— সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি চাইলে তাঁদের ঋণের ক্ষেত্রেও ‘টেকনিক্যাল রাইট অফ’ করতে পারে। অর্থাৎ, বকেয়া ঋণের অংশমাত্র আদায় করে বাকিটা খাতা থেকে মুছে ফেলতে পারে। তুমুল সমালোচনার মুখে পড়ে ব্যাঙ্ক সম্প্রতি একটি সাফাই দিল বটে, কিন্তু তাতে মূল কথাটি পাল্টাল না। এই ব্যবস্থায় কার কতখানি সুবিধা, তা স্পষ্ট। ব্যাঙ্কের সুবিধা, তাদের খাতায় অনাদায়ি ঋণের বোঝা কমবে, ফলে তাদের আর্থিক স্বাস্থ্যের ‘উন্নতি’ ঘটবে। আর, ঋণখেলাপিদের তো কথাই নেই, হজম করে ফেলা ঋণের ঢেকুরটুকু তোলার দায়ও আর তাঁদের থাকবে না। বছরখানেক অপেক্ষা করার পরই নতুন ঋণ পাওয়ার রাস্তাও খুলে যাবে। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জাহানারার ভর্ৎসনাটি স্মর্তব্য: ‘আবার বলি, চমৎকার’।

এ কথা সত্যি যে, অনাদায়ি ঋণ আদায়ের যে প্রক্রিয়া, তা খরচসাপেক্ষ; আইনি প্রক্রিয়া স্বভাবতই দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। খাতায় বকেয়া অনাদায়ি ঋণের পাহাড় জমে থাকাও ব্যাঙ্কের পক্ষে সুসংবাদ নয়। ২০১৪ সালে দেউলিয়া বিধি তৈরি হওয়ার আগে অবধি ব্যাঙ্কগুলি অনাদায়ি ঋণ ধামাচাপা দিতে ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দিত— নতুন ঋণ দিয়ে সেই টাকায় পুরনো ঋণ মেটানো হত, এবং পরবর্তী কালে নতুনতর ঋণ দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা হত। ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার একটি পরিভাষাও তৈরি হয়েছিল— ‘এভারগ্রিনিং’— চিরনতুন ঋণ। ‘টেকনিক্যাল রাইট অফ’-কে তারই উন্নততর সংস্করণ বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হল, তাতে ক্ষতি কার? ব্যাঙ্ক যে টাকাটি মকুব করে দিচ্ছে, তা যেমন হাওয়া থেকে আসেনি, তেমনই তা হাওয়ায় মিলিয়েও যেতে পারে না— হিসাবের কড়ি, কারও লাভ হলে কারও না কারও ক্ষতি হচ্ছেই। সেই ক্ষতি আমানতকারীদের, সৎ ঋণগ্রাহকদেরও। তাঁরা আমানতের উপরে কম সুদ পাচ্ছেন, বা ঋণের ক্ষেত্রে তুলনায় বেশি সুদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

কিন্তু, তার চেয়ে অনেক বড় ক্ষতি হচ্ছে সমগ্র ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পরও সেই ঋণ মকুব হতে পারে, এই বার্তাটি ভয়ঙ্কর— তা আরও অনেককে প্রলুব্ধ করবে এই পথে হাঁটতে। যে অপরাধ মাফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, তা যে লোভনীয়, অস্বীকার করার উপায় নেই। বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সীদের ঋণখেলাপির সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পরে স্পষ্ট হয়েছিল, ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তক্ষেপের পরিসরটি বিপুল। সেই চাপের কাছে মাথা নোয়ানোর মূল্যটুকুও যদি না চোকাতে হয়, তবে আশঙ্কা হয় যে, ব্যাঙ্কের পরিচালকরা আরও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেবেন। ক্ষতির এখানেই শেষ নয়। ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে সম্মিলিত বিশ্বাসের ভিতের উপর। অবাধ ঋণখেলাপির সুযোগ সেই বিশ্বাসের একেবারে গোড়ায় আঘাত করে। ভারতের মতো দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উপরে সাধারণ বিশ্বাসটি টোল খেলে তার কতখানি মূল্য দেশের অর্থব্যবস্থাকে চোকাতে হবে, অনুমান করাও দুঃসাধ্য। আশঙ্কা হয়, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান পরিচালকরা এত দূর তলিয়ে ভাবতে নারাজ। কেন, সেই প্রশ্নটি করা প্রয়োজন। বিশেষত, এই সাঙাততন্ত্রের মহামধ্যাহ্নে প্রশ্নটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Unpaid Debt Banks

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}